বিমান "হাওয়াই -আড্ডা"তে নামার আগে দেখলাম বটে, চারদিকটা ধুলোধুলো, আকাশ আগুন, মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। তাই বলে এমত দাবদাহ? অগ্নিস্নানে শুচি হওয়ার এমনই ছিরি?
পরনে জ্যাকেট, পায়ে বুটজুতো, মোজাটা ভাগ্যিস খুলে পকেটে রেখেছিলাম (এমনিতে মোজা পরলে আমার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়, কিন্তু প্লেনের মেঝেতে খালি পায়ে হাঁটবো, সে বান্দা আমি নই) এই নানাবিধ ধড়াচুড়ো পরে যখন দরজা দিয়ে "জেটওয়ে"তে পা রাখলাম, ঝলসানো রুটির মত ফিলিং হলো। কলকাতার রুদ্ররুপী হাওয়া ঠাস করে এক থাপ্পড় মেরে বলল "ন্যাকা নাকি? বৈশাখ মাসে কলকেতায় আসচ, পরনে আবার মোটা জামা? কেন, এখানে গরম কি কম পড়েচে?"
হক কথা।
আসলে হয়েছে কি, আমি তো প্রথমে গেছি রানীর দেশে। সেখানে একই অঙ্গে ফুলন্ত সর্ষেক্ষেত আর চেরীগাছ, ইয়র্কশায়ার পুডিং আর চিকেন টিক্কা মশলা, আজ রোদ্দুর কাল মেঘলা। কিন্তু গরম কদাপি নেই। আবার বাড়িটা নিজের খেয়ালে হিটার চালায় আর বন্ধ করে, রেগুলেটরের ধার ধারে না। অগত্যা, ঘোর নীলবর্ণ "রেভেনক্ল" জ্যাকেটটাকে সবেধন নীলমণি করে চার দিন কাটিয়েছি। তার মধ্যে একদিনই বসন্তের হাওয়ায় খুশদিল হয়ে হাওয়াই-চটি পরে ছোট্ট বাগানে ঘুরে ঘুরে আঁকড়ি দিয়ে শুকনো পাতা আর ঝরা ফুলের ঢিবি তৈরী করেছিলাম। তারপর কলকাতা আসার পথে কনকনে ঠান্ডায় ফের বুটজুতো, নীলমণি জ্যাকেট। সেই দেখে বৈশাখবাবুর হলো রাগ, কিন্তু আমি তো নাচার।
সুটকেস মুটকেস টেনে গাড়িতে উঠেই ঢক করে একগলা গরম জল খেয়ে দুটো লেমন টার্ট মুখে দিলাম। ব্যাস, চারদিকের গরমটা পর্দার মত সরে গেল, আকাশে বাতাসে বাঁশি বেজে উঠলো। গড়িয়াহাট কেকস এর লেমন টার্ট, "রূপে সে অরুণ-বরণ, কখনো দেখি নি এমন"। তারপর দেখি আর-সালান এর বিরিয়ানি বাক্সবন্দী, গন্ধে এক্কেবারে রঙের ঝরনা। সাথে রয়েছে নরফ্লকস, সেই সাহসে বলিয়ান হয়ে ফুচকাও খেয়ে নেব প্রেমসে, এমনই প্ল্যান।
বাড়ি পৌঁছে ট্যাঙ্কির নবধারাজলে চান করে বেরিয়ে দেখি তোয়ালে নিমেষে খটখটে শুকনো। তাই তো, বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা সজোরে ঘোষণা করছে - আমি নেই, আমি নেই! কিমাশ্চর্যম ! য়ে কাঁহা আ গয়ে হম ? একচল্লিশ ডিগ্রী গরমে এক ফোঁটা ঘাম হচ্ছে না? কলকাতা মুচকি হেসে বলল - য়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কা খেল হ্যে, দেখ কেমন লাগে!
পাখার নিচে শোয়ার অভ্যেস চলে গেছে, গরম লাগছে কিন্তু গায়ে চাদর দেওয়া চাই, ACর মুখে পিঙ্গু বসে আছে, ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতা পার হয়ে টানা ষোলো ঘন্টা ঘুমিয়ে পরের দিন বেলা চারটেয় উঠলাম। বাড়ি শুদ্ধু সবাই ঘুমোচ্ছে, জানলার শিক থেকে দেয়ালের ইঁট সব তেতে লাভা, বাতাসের প্রতিটা অনু-পরমানু ছ্যাঁকা দেবার জন্যে ঘুরঘুর করছে। বাইরে তাকালাম, মুজতবা সাহেবের খাইবার পাস পার হওয়ার গল্প মনে পড়ে গেল। সাহস করে ছোটো ছাদের পানে এগিয়েছিলাম, বাইরের চিড়বিড়ে রোদ্দুরের হুমকি দেখে পত্রপাঠ পলায়ন। কি কান্ড রে বাবা, শেষে দেশটা দিল্লি হয়ে গেল?
ঠাকুরঘরের লাল সিঁড়িতে বসে বসে, মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। পনের বছর আগেও তো এরম ছিল না? গ্রীষ্মের সাথে জড়িয়ে থাকত গন্ধরাজ, বেলিফুল, লেবুর শরবত, তালশাস, মুড়িনারকোল কোরা, আমগাছে ঢিল, কাঠি কুলফি। সে সব গেল কোথায়?
ঘড়ি বলছে সন্ধ্যে, কাকপাখি চড়াইপাখিরা বাসায় ফিরছে, কিন্তু সূর্যের রক্তচক্ষু শাসনে গরম কমার নামগন্ধ নেই। একটা পাতাও নড়ছে না, এক টুকরো মেঘের দেখা নেই, আকাশের নীল রংটাও ঝলসে ফিকে হয়ে গেছে। চিন্তিত হয়ে আবার চান করতে গেলাম। এই রেটে চিংড়িপোড়া হতে থাকলে নির্ঘাত সর্দিগর্মি হবে।
আনমনে জল ঘাটছি, বাথরুমের আলোটা হুট করে যেন কমে এলো? ভোল্টেজ লাফাচ্ছে বোধহয়। আরে??? চশমা-ছাড়া চোখে ছায়া ছায়া কি যেন দেখছি, সেকি সত্য, নাকি স্বপ্ন? তড়িঘড়ি চান সেরে বেরিয়ে দেখি প্রকৃতি থম মেরে বসে আছে, চারদিকে কিসের যেন অপেক্ষা, সূর্যের মুখে একরাশ ছাই, আর দিগন্তে বিশাল কালো জটাজালে ঢাকা পড়ছে অত বড় আকাশটা।
এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া আর এক মুঠো সোঁদা মাটির গন্ধ জানিয়ে দিল, আসছে! দস্যি দামাল মেয়ে, বছরের প্রথম কালবৈশাখী! বইপত্র উল্টে, বাসনকোসন ছত্রাকার করে, রুক্ষ চুলের ঘূর্ণি তুলে, আসছে!
দৌড়ে বড় ছাদে পৌঁছতে না পৌঁছতেই দামামা বেজে উঠলো। ঘোর কালো আকাশের কোলে বজ্রগর্ভ মেঘ আর কড়কড় বাজ, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ন্ত ধুলো, খড়কুটো, শুকনো পাতা। মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ঝড়ের নাচ, সাথে বিদ্যুতের রোশনাই, শনশন বাতাসে ছুরির ফলা...হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে.
আবার দৌড় নিচে। সব জানালা খুলে, দরজা খুলে, সারা বাড়ি ধুলিধুসরিত করে, ভিতর বাহিরের সব বদ্ধ বাতাস ঠেলে বার করে দিয়ে....ঝড় নেমে আয়!
তারপর নামল বৃষ্টি।
সুরের ঝরনার মতো, অমৃতসুধার মতো বৃষ্টি। স্নেহের মতো, আশীর্বাদের মতো, করুণার মতো বৃষ্টি। সব রাগ অভিমান ধুয়ে, সব ক্ষোভ ক্রোধ হিংসার অবসান করে, অহল্যার প্রার্থনাপূরণের মতো বৃষ্টি।
জানি ঝঞ্ঝার বেশে দিবে দেখা তুমি এসে। তুমি আসবেই।
পরনে জ্যাকেট, পায়ে বুটজুতো, মোজাটা ভাগ্যিস খুলে পকেটে রেখেছিলাম (এমনিতে মোজা পরলে আমার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়, কিন্তু প্লেনের মেঝেতে খালি পায়ে হাঁটবো, সে বান্দা আমি নই) এই নানাবিধ ধড়াচুড়ো পরে যখন দরজা দিয়ে "জেটওয়ে"তে পা রাখলাম, ঝলসানো রুটির মত ফিলিং হলো। কলকাতার রুদ্ররুপী হাওয়া ঠাস করে এক থাপ্পড় মেরে বলল "ন্যাকা নাকি? বৈশাখ মাসে কলকেতায় আসচ, পরনে আবার মোটা জামা? কেন, এখানে গরম কি কম পড়েচে?"
হক কথা।
আসলে হয়েছে কি, আমি তো প্রথমে গেছি রানীর দেশে। সেখানে একই অঙ্গে ফুলন্ত সর্ষেক্ষেত আর চেরীগাছ, ইয়র্কশায়ার পুডিং আর চিকেন টিক্কা মশলা, আজ রোদ্দুর কাল মেঘলা। কিন্তু গরম কদাপি নেই। আবার বাড়িটা নিজের খেয়ালে হিটার চালায় আর বন্ধ করে, রেগুলেটরের ধার ধারে না। অগত্যা, ঘোর নীলবর্ণ "রেভেনক্ল" জ্যাকেটটাকে সবেধন নীলমণি করে চার দিন কাটিয়েছি। তার মধ্যে একদিনই বসন্তের হাওয়ায় খুশদিল হয়ে হাওয়াই-চটি পরে ছোট্ট বাগানে ঘুরে ঘুরে আঁকড়ি দিয়ে শুকনো পাতা আর ঝরা ফুলের ঢিবি তৈরী করেছিলাম। তারপর কলকাতা আসার পথে কনকনে ঠান্ডায় ফের বুটজুতো, নীলমণি জ্যাকেট। সেই দেখে বৈশাখবাবুর হলো রাগ, কিন্তু আমি তো নাচার।
সুটকেস মুটকেস টেনে গাড়িতে উঠেই ঢক করে একগলা গরম জল খেয়ে দুটো লেমন টার্ট মুখে দিলাম। ব্যাস, চারদিকের গরমটা পর্দার মত সরে গেল, আকাশে বাতাসে বাঁশি বেজে উঠলো। গড়িয়াহাট কেকস এর লেমন টার্ট, "রূপে সে অরুণ-বরণ, কখনো দেখি নি এমন"। তারপর দেখি আর-সালান এর বিরিয়ানি বাক্সবন্দী, গন্ধে এক্কেবারে রঙের ঝরনা। সাথে রয়েছে নরফ্লকস, সেই সাহসে বলিয়ান হয়ে ফুচকাও খেয়ে নেব প্রেমসে, এমনই প্ল্যান।
বাড়ি পৌঁছে ট্যাঙ্কির নবধারাজলে চান করে বেরিয়ে দেখি তোয়ালে নিমেষে খটখটে শুকনো। তাই তো, বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা সজোরে ঘোষণা করছে - আমি নেই, আমি নেই! কিমাশ্চর্যম ! য়ে কাঁহা আ গয়ে হম ? একচল্লিশ ডিগ্রী গরমে এক ফোঁটা ঘাম হচ্ছে না? কলকাতা মুচকি হেসে বলল - য়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কা খেল হ্যে, দেখ কেমন লাগে!
পাখার নিচে শোয়ার অভ্যেস চলে গেছে, গরম লাগছে কিন্তু গায়ে চাদর দেওয়া চাই, ACর মুখে পিঙ্গু বসে আছে, ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতা পার হয়ে টানা ষোলো ঘন্টা ঘুমিয়ে পরের দিন বেলা চারটেয় উঠলাম। বাড়ি শুদ্ধু সবাই ঘুমোচ্ছে, জানলার শিক থেকে দেয়ালের ইঁট সব তেতে লাভা, বাতাসের প্রতিটা অনু-পরমানু ছ্যাঁকা দেবার জন্যে ঘুরঘুর করছে। বাইরে তাকালাম, মুজতবা সাহেবের খাইবার পাস পার হওয়ার গল্প মনে পড়ে গেল। সাহস করে ছোটো ছাদের পানে এগিয়েছিলাম, বাইরের চিড়বিড়ে রোদ্দুরের হুমকি দেখে পত্রপাঠ পলায়ন। কি কান্ড রে বাবা, শেষে দেশটা দিল্লি হয়ে গেল?
ঠাকুরঘরের লাল সিঁড়িতে বসে বসে, মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। পনের বছর আগেও তো এরম ছিল না? গ্রীষ্মের সাথে জড়িয়ে থাকত গন্ধরাজ, বেলিফুল, লেবুর শরবত, তালশাস, মুড়িনারকোল কোরা, আমগাছে ঢিল, কাঠি কুলফি। সে সব গেল কোথায়?
ঘড়ি বলছে সন্ধ্যে, কাকপাখি চড়াইপাখিরা বাসায় ফিরছে, কিন্তু সূর্যের রক্তচক্ষু শাসনে গরম কমার নামগন্ধ নেই। একটা পাতাও নড়ছে না, এক টুকরো মেঘের দেখা নেই, আকাশের নীল রংটাও ঝলসে ফিকে হয়ে গেছে। চিন্তিত হয়ে আবার চান করতে গেলাম। এই রেটে চিংড়িপোড়া হতে থাকলে নির্ঘাত সর্দিগর্মি হবে।
আনমনে জল ঘাটছি, বাথরুমের আলোটা হুট করে যেন কমে এলো? ভোল্টেজ লাফাচ্ছে বোধহয়। আরে??? চশমা-ছাড়া চোখে ছায়া ছায়া কি যেন দেখছি, সেকি সত্য, নাকি স্বপ্ন? তড়িঘড়ি চান সেরে বেরিয়ে দেখি প্রকৃতি থম মেরে বসে আছে, চারদিকে কিসের যেন অপেক্ষা, সূর্যের মুখে একরাশ ছাই, আর দিগন্তে বিশাল কালো জটাজালে ঢাকা পড়ছে অত বড় আকাশটা।
আসছে? সে সত্যি আসছে?
এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া আর এক মুঠো সোঁদা মাটির গন্ধ জানিয়ে দিল, আসছে! দস্যি দামাল মেয়ে, বছরের প্রথম কালবৈশাখী! বইপত্র উল্টে, বাসনকোসন ছত্রাকার করে, রুক্ষ চুলের ঘূর্ণি তুলে, আসছে!
দৌড়ে বড় ছাদে পৌঁছতে না পৌঁছতেই দামামা বেজে উঠলো। ঘোর কালো আকাশের কোলে বজ্রগর্ভ মেঘ আর কড়কড় বাজ, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ন্ত ধুলো, খড়কুটো, শুকনো পাতা। মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ঝড়ের নাচ, সাথে বিদ্যুতের রোশনাই, শনশন বাতাসে ছুরির ফলা...হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে.
আবার দৌড় নিচে। সব জানালা খুলে, দরজা খুলে, সারা বাড়ি ধুলিধুসরিত করে, ভিতর বাহিরের সব বদ্ধ বাতাস ঠেলে বার করে দিয়ে....ঝড় নেমে আয়!
তারপর নামল বৃষ্টি।
সুরের ঝরনার মতো, অমৃতসুধার মতো বৃষ্টি। স্নেহের মতো, আশীর্বাদের মতো, করুণার মতো বৃষ্টি। সব রাগ অভিমান ধুয়ে, সব ক্ষোভ ক্রোধ হিংসার অবসান করে, অহল্যার প্রার্থনাপূরণের মতো বৃষ্টি।
জানি ঝঞ্ঝার বেশে দিবে দেখা তুমি এসে। তুমি আসবেই।