November 3, 2020


সে অনেক কাল আগের কথা, যখন ছোট ছিলাম। আমাদের নানারকম পরীক্ষা সামনে, তায় আবার শীতকাল। দাদার বোধহয় WBCS পরীক্ষা, আমার হায়ার  সেকেন্ডারির টেস্ট, ভাইকিং এর অ্যানুয়াল নাকি প্রিটেস্ট এরম কিছু একটা। 

তো, আকাশে বাতাসে প্রভূত পড়াশোনা। পড়ার চেয়ে পড়ার প্ল্যান বেশি হচ্ছে। অনেক রুটিন তৈরী হয়েছে, দিনে কত ঘন্টা পড়া কত ঘন্টা ঘুম কত ঘন্টা খাওয়া সব হিসেবে গুনে গেঁথে কাগজে লেখা হয়েছে, টেবিলময় বই খাতা পেন পেন্সিল সার সার সাজানো। জোর কদমে প্রিপারেশন চলছে।

এর মধ্যে আমার মাথায় একটা ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া এলো, যে আমরা রাত্তির জেগে এক সাথে পড়া করবো। দাদা, ভাইকিং উৎসাহিত হয়ে দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিলো। রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর ওপরের ঘরে আমি, দাদা, ভাইকিং, কম্বল, লেপ, তাকিয়া, বালিশ, বইপত্তর, চানাচুর, এক ফ্লাস্ক কফি, বিস্কুট, সবাই বেশ গুছিয়ে বসলাম। ভাইকিং অবশ্য একটু পরে শুয়ে পড়লো কারণ উপুড় হয়ে না শুলে ওর নাকি পড়া মাথায় ঢোকে না. জোর কদমে লেখাপড়া হতে লাগলো।

ইকোনমিক্সের একটা চ্যাপ্টার শেষ করে একটু কফি খাবো বলে উঠলাম। ভাইকিং আর দাদা ও আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে বিস্কুটের কৌটো খুলে বসলো। বোরবোন বিস্কুট ও কফি সহযোগে জলখাবার খেয়ে আবার পড়তে বসবো, কিন্তু নোনতার পর একটু মিষ্টি না খেলে কির'ম  একটা খালি খালি ফিলিং হয় না? অগত্যা রান্নাঘরের জালি আলমারি থেকে নাড়ু বার করা হলো। অতঃপর আবার বিদ্যাভ্যাস|

গড় গড় করে পড়া চলছে। দাদা পাতার পর পাতা লিখে চলেছে, আমি বুলেটপয়েন্ট দাগাছি, ভাইকিং  জিওগ্রাফি হজম করছে। ভাইকিং এর পশ্চারটা একটু বলি, খুপি ইন্টারেষ্টিং। উপুড় অবস্থা, কনুইতে ভর দিয়ে দুই গালে হাত, হাঁটু ভাঁজ করা, দোদুল্যমান গোড়ালি, দুই কনুইয়ের মাঝে খোলা বই। যতক্ষণ পা দুলছে, ততক্ষণ  জলবৎ তরল হয়ে পড়া মাথায় ঢুকছে। পা আটকে গেলেই কেলো, মানে গো চেং লেওন ল্যাং মেরেছে। এই দোলাচলে বোধহয় রাত্তির দুটো বাজলো। 

ভাবছি একটা টিপিন ব্রেক নিই, হঠাৎ দেখি ভাইকিং এর পায়ের দোলন বন্ধ আর দাদা গুটিগুটি চেয়ার থেকে উঠছে, আর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে আমায় শব্দ করতে মানা করছে। তাকিয়ে দেখি ভাইকিং উপুড় হয়ে, সামনে বই খুলে, আকাশবাগে ঠ্যাং তুলে, জাস্ট ঘুমোচ্ছে। সোডার মতো বুড়বুড়ি কাটা হাসি পাচ্ছে, কোনোমতে চেপে বসলাম । দাদা সন্তর্পণে বইটা ভাইকিং এর হাতের মাঝ থেকে তুলে সরিয়ে নিলো। তারপর মিহি করে ডাকলো "ভাইকিং?"
উত্তর "হ্যাঁ "
প্রশ্ন "কি করছিস"?" 
উত্তর "পড়ছি" 
প্রশ্ন "কি পড়ছিস?"
উত্তর "জিওগ্রাফি"
প্রশ্ন  "বই কই?"
উত্তর "এই তো বই" ... ফাইনালি চোখ খুলে ..." আরে! ফ্যান্টাস্টিক! বই নেই! আমি তাহলে কি পড়ছি?"

বলা বাহুল্য, সেই রাত্তিরে আর ফারদার পড়াশোনা হয় নি। আমরা বিস্কুট চানাচুর কফি শেষ করে ফ্রিজ খুলে দাদুর প্রসাদের ফল মিষ্টি সাবড়ে অজস্র হাহা হিহি আড্ডা মেরে ভোর চারটে নাগাদ ঘুমোতে গেলাম। 

March 5, 2015

ওয়েলকাম টু অস্টিন

২০০৫ সালে যখন তিনটে ঢাউস সুটকেস এবং এক ঝোলাব্যাগ বই নিয়ে বাল্টিমোর এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম, মনে হয়েছিল "আমি একা"। আজ, ২০০৭ সালে, একটা ছোট সুটকেস, একটা ল্যাপটপ ব্যাগ আর অহং-থলি নিয়ে যখন অস্টিন এয়ারপোর্টে নামলাম, মনে হলো "আমি ভয়ংকর একা"

একটু বুঝিয়ে বলি।

যখন এদেশে এলাম, সেজমাসি এয়ারপোর্টে নিতে এসেছিল, চেনাশোনা মানুষ। তারপর যেখানে যাচ্ছি সেই ইউনিভারসিটির অনেকের সাথে চেনা পরিচিতি হয়ে গেছিল। কাজেই, একা বটে, কিন্তু একটু আধটু চেনা নাম চেনা ইমেইল এড্রেস ছিল। কিন্তু কোথায় থাকব ঠিক নেই, ক্লাসের পড়ায় পাশ করব কিনা ঠিক নেই, কোনো নতুন বন্ধু হবে কিনা তাও জানি না, পড়ার শেষে চাকরি পাব কিনা তারও ঠিক নেই। সম্পূর্ণ আনসার্টেন একটা ব্যাপার। তাতেই মনে হয়েছিল, আমি একা।

অস্টিন এর পরিস্থিতি অন্য। পাশ করেছি, চাকরি পেয়ে মাইকেলকে ধন্য করেছি, কোম্পানির খরচে প্লেনে চড়ে এসেছি।বইপত্র জামাকাপড় কোম্পানির মুভাররা বাড়ি পৌছে দেবে, আমার টিকিট ওরা করে দিয়েছে, দুই সপ্তাহের জন্যে বাড়ি ও ভাড়া করে দিয়েছে। এখন একটা গাড়ি ভাড়া করে, স্বহস্তে চালিয়ে, হোটেল অব্দি পৌছনোর ওয়াস্তা। তাও মনে হলো আমি "ভয়ংকর" একা। কারণ কাউকে চিনি না। কাউক্কে বলতে কাউক্কে না । আমার যিনি বস হবেন, তেনার একটা ফোন্নং আছে, ব্যাস। ভেউ ভেউ। একটা বাংলা বলার লোক ও নেই!

লাল টুকটুকে গাড়ি চালিয়ে গুটগুট করে হোটেল, তারপর সেখান থেকে আসবাবহীন অ্যাপার্টমেন্ট, তারপর হুড়মুড় করে গাদা মালপত্র এসে পড়া, অফিস এর রাস্তা চিনে নেওয়া, সবই হলো। কিন্তু সারাদিন ইংরিজি কথা, বাড়ি ফিরে ইংরিজি টিভি, মাঝে মধ্যেই মনে হতে লাগলো, ইস সিটিব্যাঙ্ক গেলেই ভালো হত - নিউ ইয়র্কে দুটো বাংলা বলে বাঁচতাম।

এমন সময়...

ইন্দিরা পিসঠাকরুনের দৌলতে একটা ইমেইল ডালপালা ছড়িয়ে অনেক ঘুরে "গানের আসর" এর নিমন্ত্রণ নিয়ে এলো আমার কাছে। দুরু দুরু বক্ষে "যাব" উত্তর দিলাম, মৈত্রেয়ী মিত্র কে। উনিই  ব্যবস্থা করলেন আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসার ও পৌছে দেবার। গানের আসর, দুটো গান মাথায় রাখলাম, যদি গাইতে হয় । 

রবিবার, ২৯ জুলাই, বিকেলে গানের আসর। পড়ন্ত বেলায় অনেক-দিন-না-পরা শাড়ি বার করে, সেজেগুজে তৈরী। শিবনাথদা এলেন সময় মত, গিয়ে পৌছলাম Steiner Ranch এ। গানের আসরে অনেক লোকজন, মৈত্রেয়ীদি আলাপ করিয়ে দিলেন সবার সাথে। চারদিকে শাড়ি পাঞ্জাবি বাংলা কথা হাসি, টেবিল এর ওপর ঝালমুড়ি চা, সামনে হারমোনিয়াম, তবলা, মাইক্রোফোন, তার মানে সত্যিই গান হবে! জুলাই মাসের ঘোর গরমেও মনে পুলকের দখিনা বাতাস লাগলো, এ যেন লম্বা শীতঘুমের পরে বসন্তের কলকাকলি!

আসর শুরু হলো। সুন্দর গান, কবিতা, আলোচনা। ততক্ষণে আমি একটু একটু কনফিডেন্স পাচ্ছি, এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, টুকটাক কথা বলছি। এলো আমার পালা। ঢেঁকির পাড় চেপে মাইকের সামনে বসে, হারমোনিয়াম এর স্কেল ধরলাম। অচিন্ত্যদা একটু হেসে তবলাটা বাঁধলেন, আর আমার ধড়ে প্রাণ এলো। প্রথমে "আমার প্রানের পরে চলে গেল কে" তারপর "আজি বিজনঘরে" গাইলাম, তারপর আরো সবাই অনবদ্যভাবে অনুষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে চললেন। আসর শেষে খাওয়া দাওয়া, আরো গল্প, পরের আসরের পরিকল্পনা, দুগ্গাপুজোর প্রোগ্রাম, বিজয়া সম্মিলনী, কত নতুন বন্ধু...ব্যাস, অচেনা একটা শহর মুহূর্তে চেনা হয়ে গেল আর মনের পাখি ডানা মুড়ে ঝপ করে বসে পড়ল সেখানে। 

আজও আমি মনে প্রাণে অস্টিনাইট, সে যেখানেই থাকি না কেন।

April 23, 2014

দারুন অগ্নিবাণে রে

বিমান "হাওয়াই -আড্ডা"তে নামার আগে দেখলাম বটে, চারদিকটা ধুলোধুলো, আকাশ আগুন, মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। তাই বলে এমত দাবদাহ? অগ্নিস্নানে শুচি হওয়ার এমনই ছিরি?

পরনে জ্যাকেট, পায়ে বুটজুতো, মোজাটা ভাগ্যিস খুলে পকেটে রেখেছিলাম (এমনিতে মোজা পরলে আমার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়, কিন্তু প্লেনের মেঝেতে খালি পায়ে হাঁটবো, সে বান্দা আমি নই) এই নানাবিধ ধড়াচুড়ো পরে যখন দরজা দিয়ে "জেটওয়ে"তে পা রাখলাম, ঝলসানো রুটির মত ফিলিং হলো। কলকাতার রুদ্ররুপী হাওয়া ঠাস করে এক থাপ্পড় মেরে বলল "ন্যাকা নাকি? বৈশাখ মাসে কলকেতায় আসচ, পরনে আবার মোটা জামা? কেন, এখানে গরম কি কম পড়েচে?"


হক কথা। 


আসলে হয়েছে কি, আমি তো প্রথমে গেছি রানীর দেশে। সেখানে একই অঙ্গে ফুলন্ত সর্ষেক্ষেত আর চেরীগাছ, ইয়র্কশায়ার পুডিং আর চিকেন টিক্কা মশলা, আজ রোদ্দুর কাল মেঘলা। কিন্তু গরম কদাপি নেই। আবার বাড়িটা নিজের খেয়ালে হিটার চালায় আর বন্ধ করে, রেগুলেটরের ধার ধারে না। অগত্যা, ঘোর নীলবর্ণ "রেভেনক্ল" জ্যাকেটটাকে সবেধন নীলমণি করে চার দিন কাটিয়েছি। তার মধ্যে একদিনই বসন্তের হাওয়ায় খুশদিল হয়ে হাওয়াই-চটি পরে ছোট্ট বাগানে ঘুরে ঘুরে আঁকড়ি দিয়ে শুকনো পাতা আর ঝরা ফুলের ঢিবি তৈরী করেছিলাম। তারপর কলকাতা আসার পথে কনকনে ঠান্ডায় ফের বুটজুতো, নীলমণি জ্যাকেট। সেই দেখে বৈশাখবাবুর হলো রাগ, কিন্তু আমি তো নাচার।


সুটকেস মুটকেস টেনে গাড়িতে উঠেই ঢক করে একগলা গরম জল খেয়ে দুটো লেমন টার্ট মুখে দিলাম। ব্যাস, চারদিকের গরমটা পর্দার মত সরে গেল, আকাশে বাতাসে বাঁশি বেজে উঠলো। গড়িয়াহাট কেকস এর লেমন টার্ট, "রূপে সে অরুণ-বরণ, কখনো দেখি নি এমন"। তারপর দেখি আর-সালান এর বিরিয়ানি বাক্সবন্দী, গন্ধে এক্কেবারে রঙের ঝরনা। সাথে রয়েছে নরফ্লকস, সেই সাহসে বলিয়ান হয়ে ফুচকাও খেয়ে নেব প্রেমসে, এমনই প্ল্যান।


বাড়ি পৌঁছে ট্যাঙ্কির নবধারাজলে চান করে বেরিয়ে দেখি তোয়ালে নিমেষে খটখটে শুকনো। তাই তো, বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা সজোরে ঘোষণা করছে - আমি নেই, আমি নেই! কিমাশ্চর্যম ! য়ে কাঁহা আ গয়ে হম ? একচল্লিশ ডিগ্রী গরমে এক ফোঁটা ঘাম হচ্ছে না? কলকাতা মুচকি হেসে বলল - য়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং কা খেল হ্যে, দেখ কেমন লাগে! 


পাখার নিচে শোয়ার অভ্যেস চলে গেছে, গরম লাগছে কিন্তু গায়ে চাদর দেওয়া চাই, ACর মুখে পিঙ্গু বসে আছে, ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতা পার হয়ে টানা ষোলো ঘন্টা ঘুমিয়ে পরের দিন বেলা চারটেয় উঠলাম। বাড়ি শুদ্ধু সবাই ঘুমোচ্ছে, জানলার শিক থেকে দেয়ালের ইঁট সব তেতে লাভা, বাতাসের প্রতিটা অনু-পরমানু ছ্যাঁকা দেবার জন্যে ঘুরঘুর করছে। বাইরে তাকালাম, মুজতবা সাহেবের খাইবার পাস পার হওয়ার গল্প মনে পড়ে গেল। সাহস করে ছোটো ছাদের পানে এগিয়েছিলাম, বাইরের চিড়বিড়ে রোদ্দুরের হুমকি দেখে পত্রপাঠ পলায়ন। কি কান্ড রে বাবা, শেষে দেশটা দিল্লি হয়ে গেল?


ঠাকুরঘরের লাল সিঁড়িতে বসে বসে, মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। পনের বছর আগেও তো এরম ছিল না? গ্রীষ্মের সাথে জড়িয়ে থাকত গন্ধরাজ, বেলিফুল, লেবুর শরবত, তালশাস, মুড়িনারকোল কোরা, আমগাছে ঢিল, কাঠি কুলফি। সে সব গেল কোথায়?


ঘড়ি বলছে সন্ধ্যে, কাকপাখি চড়াইপাখিরা বাসায় ফিরছে, কিন্তু সূর্যের রক্তচক্ষু শাসনে গরম কমার নামগন্ধ নেই। একটা পাতাও নড়ছে না, এক টুকরো মেঘের দেখা নেই, আকাশের নীল রংটাও ঝলসে ফিকে হয়ে গেছে। চিন্তিত হয়ে আবার চান করতে গেলাম। এই রেটে চিংড়িপোড়া হতে থাকলে নির্ঘাত সর্দিগর্মি হবে।


আনমনে জল ঘাটছি, বাথরুমের আলোটা হুট করে যেন কমে এলো? ভোল্টেজ লাফাচ্ছে বোধহয়। আরে??? চশমা-ছাড়া চোখে ছায়া ছায়া কি যেন দেখছি, সেকি সত্য, নাকি স্বপ্ন? তড়িঘড়ি চান সেরে বেরিয়ে দেখি প্রকৃতি থম মেরে বসে আছে, চারদিকে কিসের যেন অপেক্ষা, সূর্যের মুখে একরাশ ছাই, আর দিগন্তে বিশাল কালো জটাজালে ঢাকা পড়ছে অত বড় আকাশটা। 


আসছে? সে সত্যি আসছে? 

এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া আর এক মুঠো সোঁদা মাটির গন্ধ জানিয়ে দিল, আসছে! দস্যি দামাল মেয়ে, বছরের প্রথম কালবৈশাখী! বইপত্র উল্টে, বাসনকোসন ছত্রাকার করে, রুক্ষ চুলের ঘূর্ণি তুলে, আসছে!


দৌড়ে বড় ছাদে পৌঁছতে না পৌঁছতেই দামামা বেজে উঠলো। ঘোর কালো আকাশের কোলে বজ্রগর্ভ মেঘ আর কড়কড় বাজ, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ন্ত ধুলো, খড়কুটো, শুকনো পাতা। মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ঝড়ের নাচ, সাথে বিদ্যুতের রোশনাই, শনশন বাতাসে ছুরির ফলা...হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে.


আবার দৌড় নিচে। সব জানালা খুলে, দরজা খুলে, সারা বাড়ি ধুলিধুসরিত করে, ভিতর বাহিরের সব বদ্ধ বাতাস ঠেলে বার করে দিয়ে....ঝড় নেমে আয়!


তারপর নামল বৃষ্টি। 


সুরের ঝরনার মতো, অমৃতসুধার মতো বৃষ্টি। স্নেহের মতো, আশীর্বাদের মতো, করুণার মতো বৃষ্টি। সব রাগ অভিমান ধুয়ে, সব ক্ষোভ ক্রোধ হিংসার অবসান করে, অহল্যার প্রার্থনাপূরণের মতো বৃষ্টি।


জানি ঝঞ্ঝার বেশে দিবে দেখা তুমি এসে। তুমি আসবেই। 


June 16, 2013

ষাট সত্তর

আমরা অবশ্য খোদ ষষ্ঠী ঠাকরুনের পুতুল বানাবো না, সেটা মামীর ডোমেইন। আমরা বানাবো ছানাপোনা - একটা ছোটো গুল্লি দিয়ে মুন্ডু, একটা বড় গুল্লি দিয়ে ধড়, সেটা থেকে বড়ির নাকের মত টেনে টেনে হাত পা, কালোজিরে দিয়ে চোখ - হয়ে গেল ষেটের বাছা। এহেন শিল্পকর্ম সম্পন্ন করে নিজেরাই হেসে কুটিপাটি, তারপর আবার বেড়াল পুতুলটা দেখে মাকড়সা মনে হচ্ছিল কারণ হাত পা লেজ গোঁপ সবই এক সাইজ। মামীর ষষ্ঠী পুতুলের লাল টিপ, লাল পাড় শাড়ি, তেনাকে পিঁড়িতে বসিয়ে কোলে কাঁখে পোনাদের স্থাপনা করা হল, পেছনদিকে একটা বটগাছের ডাল দিয়ে এক টুকরো স্নিগ্ধ সবুজ চালচিত্র হলো, শাঁখ বাজলো, ধুপ জ্বললো। বাইরে তখন আষাড় মাসের "ছায়া ঘনাইছে"। 

এর মধ্যে মাসি মেসো দাদা দিদি এসে পড়েছে, বানা বানানো শুরু হয়ে গেছে। একটা কাঁঠাল পাতায় একটু করে লিচু, জাম, আম, নারকোলকোরা, দই, ক্ষীর, কাউনের চাল, মিষ্টি। কিছু অ-কাঁঠাল, কিছু স-কাঁঠাল। এই পাতার মধ্যের মিক্সচারটা অনবদ্য খেতে - আর অবলীলায় সুরুত করে মুখে ঢুকে যায়। তারপর পাতাটা চেটে, প্লেটে গুছিয়ে রাখতে হয়, কারণ পরে গোনা হবে কে কটা খেয়েছে।

সে তো পরের কথা, ঠাকুরের ভোগে লোভ দিতে নেই - আপাতত থালায় সারি সারি বানা শোভা পেতে লাগলো, আশেপাশে পঞ্চপ্রদীপ কর্পুর জলশঙ্খ ইত্যাদি আরতির নানা উপচার। প্রদীপ জ্বালা হলো, শাঁখ কাঁসর ঘন্টা বাজলো, ঘটাপটা করে পুজো শুরু হলো। নিবেদন, আরতি, পাঁচালি, শান্তিরজল। ব্যাস, এইবার আসল আনন্দ শুরু। দিদু তার সব সন্তানদের পাখা দিয়ে হওয়া করে, হাতে হলুদ সুতো বেঁধে দিল। এরপর আমরা সারসার মাথা পেতে নিলডাউন হলাম, এক ধারসে তিন-চারটে পাখা আর দুব্বোঘাসের জলের ছিটে পড়তে লাগলো, সঙ্গে ছড়া - "কাটল কাটল মাসির শাড়ি তবু বলি ষাট ষাট, কাটল কাটল পিসির নাক, তবু বলি ষাট ষাট " (যদিও এই উক্তি আমরা কোনদিন পরীক্ষা করি নি) গুল্লুও হাসিহাসি মুখে পাখার হওয়া খেল। তারপর আমাদের হাতে সুতো বাঁধন আর অনতিবিলম্বে সুতোর মধ্যে থেকে দুর্বা/বাঁশের শীষ খুলে ফেলন কারণ ওগুলো হাতে ফোটে। তারপরই হুড়োহুড়ি করে প্রসাদ বন্টন এবং ভক্ষণ - অচিরেই আশেপাশে খালি পাতা স্তূপীকৃত হলো। আর বিকেলে যারা আসবেন তাঁদের জন্যে কিছু রইলো না বলে কিছু বেসিক বানা আবার বানানো হলো।

এর পরে দুপুরের একসাথে খাওয়া - পাঁচ ভাজা নিমবেগুন লাল শাক (প্লাস কাসুন্দী), ডাল শুক্তো মাছ, করমচার চাটনি, দই মিষ্টি। মোয়া তক্তি নাড়ু গুলো বিকেলের জলখাবার খাওয়া হবে, সঙ্গে মুড়ি আর চা। রাত্রে বাবা মাংস রান্না করবে।

দিবাভোজের পরে দিবাআড্ডা - দিদুর বড় কার্পেটে তাকিয়া বালিশ নিয়ে সবাই গড়িমসি, সঙ্গে অজস্র হাহা হীহী, আষাড়ে গল্প, অকারণ পুলক, অনাবিল আনন্দ। বাইরে নীলমনি ফুল ঝরে পড়ছে, কৃষ্ণচূড়া কলকেফুল কালো মেঘের গায়ে রঙ্গীন চুমকির মত জ্বলজ্বল করছে। কাল থেকে আবার দৈনন্দিন জীবন শুরু, কিন্তু বাঙালীর তো বছরভর পাবন - রথ টানা, রাখি বাঁধা, ঘুড়ি ওড়ানো...

আমাদের যৌথ পরিবার। শিকড় অভিন্ন রেখে দেশে বিদেশে যে ফুলেরা আজ ফুটে আছে, সবাই সেই পি ৫৪৪ এর সৌরভের সাথী।



June 15, 2013

ষাট ষাট

ইতিহাস জামাইষষ্ঠী নিয়ে আদিখ্যেতা করলেও গুনিজন মাত্রেই জানেন যে ষষ্ঠীপুজোর রকমফের আছে, যথা নীল, জামাই, শীতল ও অন্যান্য। আমাদের বাড়িতে জুনমাসের যে ষষ্ঠীপুজো হয়, সেটায় পুজো এলিমেন্ট কম, পার্বন বেশি। আর সেদিন জামাই বলে নয়, বাড়ির সব সন্তানরাই আদর পেয়ে থাকে। আর ব্যাপারটা যেহেতু গরমের ছুটির মধ্যে, তাই পড়াশোনা নিয়ে সেদিন বা তার আগের দিন বা তার পরের দিন বিশেষ মাথা না ঘামালেও চলে। অতএব, জুন-ষষ্ঠী আমাদের কাছে খুবই আকর্ষক একটা দিন ছিল। বড় হয়েও আকর্ষণ কমে নি, কিন্তু ছোটবেলার স্মৃতিগুলো বেজায় ভীড় করছে...

দিন চারেক আগে থেকে রং মিলিয়ে মিলিয়ে নতুন জামাপত্র কিনে রাখা হলো, দিদুর অর্ডারে। আমাদের বোনেদের ফ্রক, ভাইএর পাঞ্জাবি, মামা আর বাবার টিশার্ট, মা মামীর শাড়ি, গৌরদার ফতুয়া।আগের দিন রাত্রে মামী কাউনের চাল ভিজিয়ে রাখল, আর খইএর মোয়াতে পাক দেওয়া হলো - তার গন্ধে আমাদের প্রাণ উদাস। আমরা ভাইবোনেরা অজস্র কাঁঠাল পাতা ছেঁটে রাখলাম, আর খাবার ঘরের সাইডবোর্ডে নতুন সুতো, হলুদ, ফুল, বেলপাতা, দুব্বো, ফল, মিষ্টি, কাঁচি এইসব সারসার সাজিয়ে রাখা হলো। গৌরদা যাদবদাস থেকে দই এনেছে, আর লেবু সন্দেশ। মামা এনেছে কালোজাম কাঁঠাল আম লিচু জামরুল, ইলিশ / পাবদা, নারকোল। বাবা মনোহর পুকুর রোড এর সেই স্পেশাল দোকান থেকে মাংস এনেছে, সেটা পরের দিন রাত্রে খাওয়া হবে। এলার্ম দিয়ে শুলাম, ভোরে উঠে মাদার ডেয়ারী-ওয়ালাকে ধরে দু প্যাকেট দুধ বেশি নিতে হবে, ক্ষীর তৈরী হবে। (কিড়িং করে এলার্ম হয়ত বেজেছিল, আমরা উঠি নি। বিপত্তারিনি মামী কিম্বা গৌরদাই দুধ কিনে, বড় পেতলের কড়ায় ক্ষীর করতে বসিয়ে দিয়েছিল)


আমাদের উঠতে উঠতে মা দের চানটান সারা, চুল-ধোয়া জল বাটিতে রাখা হয়েছে, করমচা ধান বাঁশের-কুড়ুল দুর্বা দিয়ে পুঁটলি বাঁধা হয়েছে, হাতপাখার ওপর সেই পুঁটলি, বড় আম, আর জলের বাটি রাখা হয়েছে । ঠাকুরঘর থেকে তিনতলার বড়ঘরে প্রদীপ, পিলসুজ, কাঁসর, ঘন্টা, শাঁখ, পুষ্পপাত্র, কোশাকুশি, পাথরের থালা বাটি গেলাস সব আনা হয়েছে। আল্পনা আঁকা শেষ, তার ওপর বড় পিঁড়ি বসানো হয়েছে, ভানুদি, মনিদি, মলিনাদি সবাই খুব ব্যস্ত রান্নাঘরে - নারকোল নাড়ু, তিলের তক্তি, আরো নানান্ খানা তৈরী হচ্ছে। বারো আনা কাজই শুরু হয়ে শেষ হতে চলেছে।


তাতে অবশ্য আমাদের কিছু এসে যায় না কারণ আমরা ছোটো। কাজেই চা-টা খেয়ে চান করে নতুন জামাকাপড় পরে ছোটোদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।চন্দন বাটা, পঞ্চপ্রদীপের সলতে সাজানো, লিচু ছাড়ানো, কালোজাম-আম-জামরুল কাটা, (দু-একটি খাওয়া) আর চালের গুড়ো-ময়দা দিয়ে মা ষষ্ঠী র পুতুল তৈরী করা। 




(পরের কিস্তি এখানে : http://bokombokom.blogspot.com/2013/06/blog-post_16.html)






June 11, 2013

The Sixth Day

(the Bengali version is here : http://bokombokom.blogspot.com/2013/06/blog-post.html )

History has pegged Jamaishoshthi as an important and integral part of every Bengali household. What is not so widely known is that in many households, children count before the son-in-law, on this auspicious sixth day. Those houses have their priorities right, methinks. 

Take our household, for instance. Growing up in a semi-joint family, Shoshthi was a grand summer affair. Typically occurring in the middle of summer vacations, we'd look forward to D day with anticipation and excitement. New clothes would be bought for the kids (and the sons and daughters and their spouses too) and we'd spend agonizing hours on colour-coordinating outfits for our entire band of cousins. 

And this is how it would unfold.

The night before. We gather, wash and trim bunches of kathal pata and Mami soaks a bowlful of kauner chal. Karamcha, dubbo and kacha holud grace the top of the large sideboard, along with spools of new thread and taalpatar pakha. Mama returns from Gariahat Market with large Ilish, mangoes, lichu and kalojaam. Gourda gets doi and mishti from Jadav Das. Baba brings the fattiest mutton from Monohor Pukur Road. And we set alarms to wake up early and catch the "Mother Dairy" dudhwala to buy extra packets of milk for kheer. The dried-milk version, not North Indian payesh.

Day of. Ma Mami Didu shower and collect some chul-dhowa jol in bowls, and make little putli of durba, karamcha and dhaan. And then get busy in the kitchen, making mowa, kheer and narkel naru.  We quick-shower, wear our new clothes, and assist in the cutting and peeling of fruits (in the process, eating a few lichus and kalojaams here and there). Mami then makes a Ma Shoshthi idol with moyda/chaler guro paste, and paint eyes and nose and mouth and hair and a red tip. We make a dozen of her chhanapona idols, and giggle on their ungodlike appearance. Oh and of course the cat-idol is made with great care too, complete with a curled tail and stiff whiskers. Now Mami sits Ma Shoshthi down on a piri, puts her children and her cat around her, and sticks a kathaler daal as background, to make things sylvan. 

Pilsuj-prodeep, shonkho, ghonta and other paraphernalia are brought down from Thakurghor to tintolar boroghor; chondon paste is made, flowers overflow from the big copper pushpo patro, and wisps of dhup-smoke carry that special pujo-fragrance to every part of the house. 

The pujo is the least time-consuming action of this day. More time is spent on prepping cotton thread with holud, and durba, arranging noibidyo and making today's piece de resistance - bana. What is a bana? Take a kathalpata, trim its top and bottom end, put a little bit of everything on it (aam lichu kalojam doi kheer mishti kauner chal) and voila! you have a bana! They come in two versions - with kathal, and without kathal. And you have to eat the whole thing at one go. No, not the leaf, but the contents of the leaf. The taste? Hamin ast!

So we arrange the stacks of bana, light more dhup, make a lot of noise with kashorghonta and shonkho, then sit ourselves down in a semi circle, and Mami starts to recite pNachali. After the littany, Didu fans her children with her special haatpakha, and sprinkles water on their heads with the koromcha-dhaan putli (which has a long tuft of  durba for this express purpose) then we present our collective heads to be fanned and sprinkled with water as well. (Gullu, Pingu are not exempt). Ma, Mami, Didu chant " katlo katlo mashir sari, tobu boli shaat shaat, katlo katlo pishir naak tobu boli shaat shaat " thus letting us know that today is the day of permissiveness, today we can do no sin. Of course, being good kids, we never put that to test.

After the fanning and the chanting, yellow threads are tied on our wrists, and we let Ma Shoshthi enjoy the fruit and sweet fare for all of 15 minutes. Then, competition on who can eat the most "bana" heats up, so much so that we have to make some extra ones for everyone else.

Lunch is served to the sons-in-law and the kids first. Pachta bhaja, neem begun, shaak, daal, shukto, shorshe ilish, mangsho, koromcha chatni, doi, and proshaad is eaten with much slurping, and almost always, the afternoon sees bunches of rainclouds gathering eastward, thus making post-lunch adda so much better. 

Evening brings a snack of muri and peyaji, and then leftovers for dinner. We step back into the mundane, but not before counting out the days until Rathjatra, then Rakhipurnima, then Bishwakarma pujo...

Ours is a culture of Parboni. One more than the number of months there is.





April 14, 2013

নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এলো প্রাণে

মাস ফেব্রুয়ারী, তারিখ দোসরা। মায়ামীর মনোরম বাতাসে বসন্ত পঞ্চমের  ছোঁয়া লেগেছে, শিউলিগাছটা  অকারণে ফুল বিলোচ্ছে, গিরগিটি লাল গলা ফুলিয়ে গিরগিটিনীকে পটাচ্ছে।

গড়িমসি করে ঘুম থেকে উঠে আবার একটু রেস্ট করছি,  আর ভাবছি ডাম্বলডোর কেন ফিনফিনে পাতলা জোব্বা পরেছে, আর তলায় সুপারম্যানসম নীল ইয়ে, আর এর মধ্যে গ্যানডল্ফ কেন কালো, আর আমি এইরকম খাপছাড়া স্বপ্নই বা দেখি কেন। বেলা হয়েছে ঢের; প্রদীপ্ত চুল-চাঁচা-যন্ত্র দিয়ে কদম ছাঁট দিছে, বাইরে মুখোশ পরা লোকজন ঘাস কাটছে, ফোনে ফাবিওলার অধরা ডাক।

এমন দিনে রেস্টুরেন্টে খেতে হয়।

সে অবশ্য আমরা বাইরে বেশ ঘন ঘনই খাই, নানা কারণে  যেমন - আহ আজ কি দারুন হাওয়া দিচ্ছে, বাইরে খাওয়া যাক। অথবা, বাবা আজ কি টায়ার্ড লাগছে, চল বাইরে খাই। কিম্বা, কাঁচা বাজারের যা দাম, তার চেয়ে বাইরে খেলেই তো হয় - এই সব নানা অজুহাতে আমরা পান্ডা এক্সপ্রেস / লাজীজ / উদিপী ইত্যাদি দোকানদের উন্নতিসাধন করে থাকি। আজও তাই উইকেন্ড উদযাপন করতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, কোকোনাট গ্রোভের উদ্দেশে।

কফি ডিমেরপোচ আলুভাজা ফ্রেঞ্চটোস্ট (তাতে আবার চিনি আর কলার টুকরো দেয়া, সেগুলো সযতনে পরিহার করা হয়)  ইত্যাদি উপাদেয় ব্রাঞ্চ খেয়ে ভার্চুয়াল খড়কে-কাঠি চিবোতে চিবোতে আমরা এদিক ওদিক হাঁটতে  বেরোলাম - অবচেতন মনের ব্যাপার, পা চলে গেল Petco র দিকে। আরো গভীর অবচেতন - সেদিন ওখানে adoption আছে। যাক গে, সেসব তো পরে "what-if " করে দেখা হলো, আপাতত আমরা এগিয়ে চললাম।

কাছে আসতেই "ম্যাও ম্যাও ম্যাও বকম বকম ভৌ ভৌ ভৌ  চিহী" - আমি বললাম " একি, এটা তো Petco! আচ্ছা চল একটু দেখে আসি কি ঘটছে, আর মুসের জন্যে একটা খেলনা নিয়ে যাই" - মুস পড়শীর ৭০ কেজি গ্রেটডেন , আমি তাকে বেবিসিট করি রোজ। 

ঢুকলাম ভেতরে। মেঝের ওপর ছোটো ছোটো জালের বেড়া, তার ভেতরে পুতুল পুতুল চেহারার ভুলুয়া আর পুষিরা শুয়েবসে আছে, আর চারদিক ঘিরে মানুষ-ছানারা কলরব করছে। বর্ণে গন্ধে শব্দে একেবারে ঘটনার ঘনঘটা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় চোখ পড়ল একটা সাদা তুলোর বলের ওপর। গুটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে, দেড় বিঘত সাইজ হবে। কাছে যেতেই গুটলির ভেতর থেকে একটা মাথা বেরোলো। তাতে জলদস্যুর মতন কালো চোখ-পট্টি, দুটো নীল চোখ মিটমিট করছে, আর একটুখানি গোলাপী জিব কচি দাঁতের ভেতর থেকে উঁকি দিছে। 

শরদিন্দুর শরণ নিয়ে বলতে হয় - মনে হইল সম্মুখের পৃথিবীটা একটুখানি সরিয়া গিয়াছিল, এখন খাপে খাপে মিলিয়া গেল।

"বিংগো" এলো ঘরে। 

January 21, 2013

সূর্য উনুন ওরফে ঝটিকা সফর - ৫


এটা গতবারের কথা - সেই যে সাড়ে সাত দিনের জন্যে কলকাতা গেলাম, সেই বারের। নানা মজারু ঘটনা চলেই থাকে, সেসব আগে বলেছি, এটা ভুলে গেছিলাম। অতএব...

বিদেশে ফেরার আগের দিনের কথা, শুক্রবার। রাত্রে মা আমি বনি খেতে বসেছি, পিঙ্গু লেজ এলিয়ে হাসিমুখে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে। তখন ওই রান্নার গ্যাস নিয়ে নানা ঝামেলা শুরু হয়েছে, ৯/৬ কেস।

খেতে খেতে মা খুব চিন্তান্বিত হয়ে বলল " এবার থেকে মাইক্রোওয়েভ বেশি বেশি ব্যবহার করব।"

আমি খুশি হয়ে - " এই তো, কম তেলে রান্না, মাইক্রোওয়েভ, এ সব খুব ভালো, শরীর ভালো থাকে"

মা রেগে গিয়ে - " কম তেলের কথা হচ্ছে না, গ্যাস সিলিন্ডার ৬টা মাত্র দেবে জানিস না? কোন দেশে যে থাকিস? "

বনি - " দিদিভাই আমেরিকায় থাকে মা, তুমি ভুলে গেছ? "

মা পাত্তা না দিয়ে গজগজ করতে থাকল - " এতগুলো লোকের রান্না গ্যাসে, দুদিনেই তো ফুরিয়ে যাবে। তারপর আবার সুমিত্রা তোয়ালে বালিশের ঢাকা সব সোডা দিয়ে গরম জলে ফোটায়..."

আমি - " ওগুলো তাহলে মাইক্রোওয়েভ এ দিয়ে দিও, একদম ফটফটে সাদা হয়ে যাবে..."

মা - " ইয়ার্কি মারিস না, তুই তো রান্না করিস ঘোড়ার ডিম, তুই কি বুঝবি একটা এতবড় সংসার চালাতে কত চিন্তা করতে হয়..."

বনি - " মা তুমি একটা সোলার কুকার কেনো। সক্কালবেলা সুনীতা ছাদে ভাত ডাল ডিম সব সেদ্দ করতে দিয়ে আসবে, দুপুরের মধ্যে সব ফিনিশ..."

আমি - " অথবা তিন চারটে সোলার কুকার নিয়ে মা সুনীতা সুমিত্রাদি শম্পা সবাই বিবেকানন্দ পার্কে গিয়ে লাইন দিয়ে বসিয়ে রাখবে, একটা কাকতাড়ুয়া সেট করে পাশে..."

বনি - " আর যেদিন যেদিন মেঘ করবে, সেদিন সবার উপোষ। আর বর্ষাকালটা তো মুড়ি খেয়েই কাটাতে হবে, এক দেড় মাস সূর্য উঠবেনা, সোলার কুকারো চলবে না...তখন বরং আমরা হাতারি থেকে খাবার আনাব, কি বল দিদিভাই? "

সেদিন রাত্রে মাকে আর ফারদার ঘাঁটাই নি :) 

October 3, 2012

গাড়ল গরু


টেক্সাসের আদিগন্ত বিস্তৃতি। ফিরোজা নীল আকাশের বাটিতে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই, সোনালি গমের খেত পেকে ঝমঝম করছে। মাঝখান দিয়ে সরু ফিতের মতো সোজা কালো রাস্তা। খেতের সীমানার অন্তে সবুজ রমালের মত টুকরো নরম মাঠ, তার চারধারে সাদা বেড়া। ইতস্ততঃ গরু চরছে, বিখ্যাত "লংহর্ন"

"নেসি" - মধ্যরাত্রিনীল নিসান - বনেটে দুপুরের রোদ্দুর ঝলসিয়ে গড়গড়িয়ে চলেছে। ভেতরে স্বয়ং আমি আর ল্যাংবোট। ভাতঘুমে গাড়ি চালাচ্ছি, একটা ঝিমধরা ব্যাপার।

ল্যাং - কত্ত গরু! হ্যামবার্গার খাব!
আমি - এই তো খেয়ে বেরোলি!
ল্যাং - গরু দেখলেই আমার খিদে পায়।
আমি - তুই নরকে যাবি!
ল্যাং - নাহ, ওটা কলকাতায় খেলে হয়, এখানে অন্য সিস্টেম।
আমি - তোর মতো চোখের-খিদে জনতার জন্যে একটা করে মেশিন দরকার। বড় একটা বাক্স টাইপ। গরু অন্দর, বার্গার বাহার। একদিক দিয়ে গরু ঢুকবে, অন্যদিকে পটাপট বার্গার বেরবে। পাশ দিয়ে শিং খুর ল্যাজ একটা ব্যাগে জমা হবে, আর গ্যালগ্যাল করে রক্ত বেরিয়ে একটা বালতিতে পড়বে।
ল্যাং - ওয়াক ওয়াক। ঠিক আছে, ম্যাকনাগেট খাই তাহলে। গাড়ল গরু সব। আর ঘোড়া তো খাওয়া যায় না। ঘোড়েল ঘোড়া।
আমি - তোর বাংলায় ব্যুৎপত্তি দেখে আমি স্তম্ভিত।
ল্যাং - স্তম্ভিত মানে যেন কি? খুশি হওয়া, না?

আধঘণ্টা পর -দেখছি কোথায় কফি পাওয়া যায়। ল্যাংবোট ঘুমিয়ে পড়েছিল,গাড়ি থামতেই চমকে উঠে বসল (এটা ইংরিজিতে লিখতে হবে) কি হয়েছে? Are you pheeling hejji? And a litil diji?
আমি কিছু হয় নি, কফি কিনব।
ল্যাং তাই বল। আমি ভাবলাম you are going creji, মাঠের মধ্যে গাড়ি থামিয়ে তেল খুঁজবি হয়তো।

আজেবাজে কথা পাত্তা দিলাম না। কফি নিয়ে আবার গড়গড়।

There ij a cool breej on the briz.  ল্যাং ছোট্ট কমেন্ট হাওয়ায় ভাসিয়ে  গুটিসুটি মেরে ঘুমোনোর তোড়জোড় করতে লাগলো। ধারেপাশে যদিও ব্রিজের ব ছিল না।

(জুন, ২০০৮)

October 1, 2012

দিন দুপুরে ...

(বড়মাসি অস্ট্রেলিয়াতে ৪০ বছর কাটিয়ে সদ্য কলকাতা ফিরেছে)

দুপুরবেলা, তীব্র গরম পড়েছে। ফুলস্পিডে পাখা চালিয়ে দিদু আর বড়মাসি খেতে বসেছে। গৌরদা (দিদুর বাজার সরকার/লোকালগার্জেন/অ্যাসিস্ট্যান্ট) পরিবেশন করছে - মুসুর ডাল, আলু-কুমড়ো-সেদ্ধ-নুন-তেল, ভাত, বড়ি দিয়ে মাছের ঝোল, কাঁচা আমের চাটনি, টক দই।

বড়মাসি বেশ আনন্দে আছে। মিনারেলজল খাচ্ছে না, রেগুলার বাইরে খেয়েও পৈটিক গোলযোগ হয় নি, কলকাতার গরম তাকে কাবু করতে পারে নি। জাহাজে তার অনেক জিনিস আসছে, তার মধ্যে দুটো টেনিস র‍্যাকেট, একটা পাউরুটি-মেশিন আর একটা খাতার কথা আমরা সমানে শুনছি। "সেইবার আমরা ক্রুজে গিয়ে একটা কি দারুণ জিনিস দেখলাম জানিস তো, লাল মত, পেটের কাছটা নীল...দাঁড়া, আমার খাতা আসছে, ওতে সব লেখা আছে" কিম্বা "চাইনিজ রাজকন্যাগুলো কি সুন্দর! সিল্কের ওপর সিল্ক পরেই যাচ্ছে পরেই যাচ্ছে, কোমরে এই মোটা সোনার বেল্ট তাতে নানারকম জেড আর রুবি বসান...ছবিটা আমার খাতায় আছে..."

যাই হোক, দুপুরবেলা বড়ঘরের খাবার টেবিল।

গৌরদা বড়মাসির থালায় ডাল দিতে দিতে বলল "বাড়িটা তো চিড়িয়াখানা বানিয়েছেন ভাল। দুটো গিধনি পাখি নিয়ে আসুন এবার, পায়ে দড়ি বেঁধে দেবেন, ছাদে উড়ে বেড়াবে।"
বড়মাসি উৎসাহিত "গিধনি পাখি কিরে? হাতিবাগানে পাওয়া যায়?"
গৌরদা  সবজান্তা হেসে "কি যে বলেন! ওকি পোষা পাখি? ও থাকে পাহাড় চুড়ায়, জোড়া বেঁধে। একা ওরা বাঁচেনা, আর ধরলেও বাঁচেনা"
বড়মাসি বিভ্রান্ত "এই যে বললি পুষতে? ঠাট্টা করলি বুঝি?"
গৌরদা ক্ষুণ্ণ "না না! আমরা দেশের বাড়িতে ওদের ডাক শুনেছি, এই বড় বড় পাখি! যে সাপের মাথায় মানিক থাকে, সেই সাপ খায় ওরা। সাপের মাথার মানিক জানেন তো? নাকি অশটেলিয়াতে থেকে সব ভুলে গেছেন?
বড়মাসি উত্তেজিত "সাপের মাথায় মানিক? কই আমি দেখিনি তো? সিডনি জুতে অবশ্য সাপের দিকটা আমি বেশি যেতাম না - ওগুলো বড্ড কিরম যেন লাগে - কিন্ত নিকিকে বলতে হবে, ওর এসব হিস্ট্রি জানা দরকার!" (নিকি বড়মাসির নাতি)
গৌরদা খুশি হয়ে "হ্যাঁ, আমি তাই বলছি! সাপ মাথার মানিক রেখে সেই আলোতে পাখিটাখি ধরে খায়। আর গিধনি সেই সাপ খুঁজে বার করে, আর যাদের পোষা হয়, তারা বড়লোক হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশের রাজাগজারা খুব বদমাশ, সব মানিকটানিক ওরাই নিয়ে নেয়, গিধনির মালিক কিছু পায় না। গরিবমানুষের কত কষ্ট বলুন। আর এই যে ভোট আসছে, আবার একগাদা মানুষ মরবে, রাজারা আরো বড়লোক হবে। সাধে কি দেশটা সাহেবরা ... "

ফোঁস করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে গৌরদা রান্নাঘরে দই আনতে গেল।

বড়মাসি এদিকে মহা চিন্তায় পড়েছে, নিকিকে না জানানো অব্দি শান্তি নেই। " এইসব ফোকটেলের কিছু বই আনিস তো, পম্পি? নিককে পাঠাতে হবে। ও খুব ভালবাসে বই পড়তে, ওর বারো বছর হলে বন্ধুদের নিয়ে এখানে আসবে বলেছে, আমাদের এই বাড়িটা ওর দারুণ পছন্দ। কিন্তু...আমি কোনোদিন গিধনি পাখি... আচ্ছা গৌর ইয়ার্কি মারছে, না? "

দিদু এতক্ষণ এই আষাঢ়ে কথোপকথনে পাত্তা না দিয়ে  মনোযোগসহকারে মিলিকে আমের চাটনি খাওয়াচ্ছিল, হঠাৎ খেয়াল করল বড়মাসি শুকনো হাতে বসে আছে। "রাণু? বসে আছ কেন? পেট ভরেনি বুঝি? আরেকটু চমচম খা। আর ওইসব সাপটাপ আমার ভাল লাগে না, গৌরকে মারব আমি, আজেবাজে কথা বলে মাথা  ধরিয়ে দিল। গৌর? রানুকে চমচম দিয়ে দই দে, আর একটা কথাও বলবি না। যা তুই খেতে বস। রানু, যাও হাত ধুয়ে একটু শুয়ে নাও, অনেক বেলা হল।"

চুরাশি-বছুরে মায়ের আদেশে পঁয়ষট্টি-বছুরে মেয়ে চটপট উঠে হাতমুখ ধুয়ে নাকে চশমা এঁটে সটান ডিভানে শুয়ে "Silk Route" এর পাতায় মগ্ন হয়ে পড়ল। 


(২০০৫, এপ্রিল মাস)

র‍্যান্ডম একদিন

আমার বোন/ধু "চি" মাসছয়েক আমাদের কাছে ছিল, গত বছর। 

এমনিতে ও প্যাঁচা প্যাটার্ন, রাত্রে জেগে থাকে দিনে ঘুমোয়। কাজেই, আমরা যখন আপিস কাছারি শেষ করে রাম-টায়ার্ড অবস্থায়ে টিভির সামনে জিরোতে বসি, তখন ওর রাজ্যের এনার্জিতে ফুটকড়াই অবস্থা। এই আলু-ফুলকপি রান্না করে ফেলছে, এই চেলো কাবাব বানাচ্ছে, এই গাদা কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে মায় ভাঁজ পর্যন্ত করে ফেলছে - অভ্যেস এমন খারাপ করে দিল যে ও ফিরে যাওয়ার পর ওই ভাঁজ করা কাপড়ের লোভে বাড়ির সামনে কিউবান ধোপাকে কাপড় দেওয়া শুরু করলাম - যদিও তার নাম জাফর। আর রান্নাঘরে মশলার তাকে এলাচ-লবঙ্গ-দারচিনি-লঙ্কা-হলুদ-তেজপাতা-জিরে ছাড়া যে এক গন্ডা কৌটো আছে, সেগুলো আমি চিনিও না, ব্যবহারও করি না।

সে যাক গে। এমনি একদিন, খুব বৃষ্টি পড়ছে। 

বৃষ্টি পড়লে মনটা যুগপৎ ভালও হয়, খারাপও হয়। সেই দোলাচলে মুড়ি পেঁয়াজি চা ব্যাপারটা জমবে ভালো। এদিকে সূর্য আজ ওঠেনি বলেই বোধহয় - ডাক্তারবাবু সন্ধ্যের মুখে বাড়ি চলে এসেছেন। পেঁয়াজ ব্যাসন লঙ্কা নুন গুলে, চা বানিয়ে, "চি" কে ডাকতে গেলাম। 

আমি - উঠে পড় উঠে পড়, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
"চি"  সোফাতে ঘুমন্ত।
আমি - কিরে, উঠবি না?
"চি" তাও ঘুমন্ত।
আমি মৃদু ঠেলা দিয়ে - এই, ওঠ!
"চি" মাছি মারার মতো করে আমার হাতে এক চাপড়
আমি - আহ! মারছিস কেন? 
"চি" ঘুমন্ত অবস্থায় - মজা 
আমি - মজা? বার করছি তোর মজা (কাতুকুতু দেওন)
"চি" - উঁ উঁ ...বলছি আমি কাজটা শেষ করেই আসছি 
আমি - এখনি ওঠ, এক্ষুনি 
"চি" - বাড়ি চলে গেছে
আমি - কেউ বাড়ি যায় নি, পেঁয়াজি বানাচ্ছি খাবি চল 
("চি" হাঁ করে অপেক্ষা করন )
আমি - এখানে দেব না, খাবার টেবিলে চল 
"চি" পাশ ফিরে - আচ্ছা, কাল যাব।

সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না দেখে, ঘরের সব আলো জ্বেলে জোরসে এক ঠেলা মারলাম - আধখানা লাল চোখ খুলে গেল - সকাল হয়ে গেছে?
আমি ঘটঘট করে জানলা বন্ধ করতে করতে - সকাল সেই সকালে হয়েছিল, এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আর তুই আমাকে মেরেছিস।
"চি" ভোম্বল অবস্থায় - মেরেছি? কেন? 
আমি ভিকটিম মুখে - কেন আমি কি জানি? আমি তোকে পেঁয়াজি খেতে ডাকতে এলাম ..." 
"চি" করুণমুখে - ইস সরি সরি। ঘুমের মধ্যে আমি বুঝতেই পারি না ..." 

এর পর আমায় পেঁয়াজিও ভাজতে হলো না, চাও করতে হলো না। রাত্রে উত্কৃষ্ট খিচুড়ি রান্না হলো, সাথে ডিমভাজা আর পাঁপড়।

এখন বৃষ্টি পড়লে ম্যাগি বানাই আর ডাক্তারবাবু হা-হুতাশ করেন।

(জুলাই, ২০১১)

এতদ্দ্বারা "চি" কে সত্বর ফিরিয়া আসিতে অনুরোধ করা হইতেছে 

September 30, 2012

ঝটিকা সফর - ৪


সোমবার থেকে পুরোদস্তুর অফিস সুরু, তার আগে চট করে Select Stores যাব। গড়িয়াহাটার মোড়, মিনিমিনি বাসবাস, সঙ্গে ল্যাংবোট চিঙ্কি। সিমুর বিয়ে, কাঁথাস্টিচের শাড়ি কেনার প্ল্যান ময়ূরকণ্ঠী রঙের।
দোকানে গিয়ে  যদিও এই 'স্পেক' দিয়ে বলেছি শাড়ি দেখান, কোন এক অজ্ঞাত কারণে যে শাড়িগুলো দেখানো হতে লাগলো, সেগুলো না কাঁথাস্টিচ, না ময়ূরকণ্ঠী। সঙ্গে ম্যাজিশিয়ানের প্যাটার - "এইটা দেখুন, অনবদ্য কালার, অসাধারণ কাজ, এই এক পিসই পড়ে আছে"...অথবা  "এটা এই পুজোয় লেটেস্ট ফ্যাশন, কন্ট্রাস্ট দেখেছেন?" এর মধ্যে চা এসে গেছে এক রাউন্ড "আরেক কাপ চা দি, দিদিভাই?"

আমরা বৃথা তর্ক না করে বসে বসে গোটা পনেরো বিভিন্ন রং-রকম-দামের শাড়ি দেখে, একটাও পছন্দ না করে উঠি উঠি করছি "চল ওদিকটা যাই, ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলি..." শাড়িকাকু মিনতি করলেন "দিদিভাই, এক মিনিট, আরেকটা জিনিস দেখে যান।" তারপর গলা খাদে করে রহস্যময় ভাবে ডাকাডাকি করলেন "মদনা - ভেতর থেকে ওই মালটা বার কর তো, যেটা পেশাল অর্ডারি" আবার পাঁচটা শাড়ি এসে পড়ল, এগুলো সুন্দর দেখতে কিন্তু একটাও কাঁথাকাজের না। যাই হোক, ধৈর্য শেষ, খিদে পেয়েছে, বাজখাঁই নামের বেশ জমকালো শাড়ি কিনে বাড়িমুখো হলাম।

এসে দেখি মা ওষুধের প্যাঁটরা খুলে বসেছে। এই প্যাঁটরাটা আমার, প্রতিবার রিফিল করা হয়, চেনা ওষুধ সঙ্গে থাকলে মনে বল পাই। মা এক একটা পাতা দেখছে আর আঁতকে আঁতকে উঠছে -
(মা) এমা, এটা তো ডেট এক্সপায়ার করে গেছে, ছিঃ ছিঃ এত্তগুলো ক্রোসিন... এহহে, র‍্যানট্যাকগুলো গলে গেছে তো..আচ্ছা আগেরবার যে ব্যাকট্রিম দিলাম, সেগুলো খাস নি?
(আমি) কি আশ্চর্য মা, দরকার না হলে খাব কেন? আমি অত ওষুধ খাওয়া পছন্দ করি না, গাদা গাদা অ্যান্টি বায়োটিক খেয়ে সব রেসিস্টেন্ট...
(মা) রেখে গেলেই পারতিস, আমরা খেয়ে নিতাম।
(আমি) খেয়ে নিতে? এটা আচার না মশলা যে অকারণে খেয়ে নিতে?
(মা) আহ আমি না খেলেও, এই ধর ববিতার কদিন আগে পেট খারাপ হল, তারপর চন্দ্রদীপের গ্যাস্ট্রাইটিস...(ববিতা গলি-সিঁড়ি-ছাদ ঝাঁট দেয়, চন্দ্রদীপ হোল ধোপা)

বাকরুদ্ধ হয়ে চান করতে গেলাম।

বর্ষার দুপুর - লুচি আলুরদম চাটনি খেয়ে, পিঙ্গুকে পান খাইয়ে, ল্যাপটপ বার করে ইমেল দেখব। তখনি কবি কাঁদলেন, অর্থাৎ ক্রোম বলল কানেকশান নেই। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। নতুন কাজ, বসকে বলে এসেছি কোওনো ব্যাপাআআর না, কলকাতা থেকে হইহই করে আপিস করতে পারব...এতো মহা গেরো! বিমর্ষ হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি - ওমা, দেখি আউটলুকে বানের জলের মতো ইমেল আসছে! ইদিকে কোনো ওয়েবপেজ খুলছে না - যাকগে যাক, জয় বাবা ফেলুনাথ, এযাত্রা চাকরিটা বজায় রইল। নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে গেলাম - যাকে বলে ন্যাপ - আবার ৬টার মধ্যে উঠে পড়তে হবে।

বেখাপ্পা সময় কাজ - সন্ধ্যে ৭টা থেকে রাত্তির ৩টে। কিন্তু ঘনঘন কমিক-রিলিফ-ব্রেক, মিটিঙের ফাঁকে দরজা দিয়ে পিঙ্গুর উঁকি, মায়ের মাইম করে জিজ্ঞেস করা কতক্ষণ পরে খেতে বসতে পারব - এসব যখন দাঁড়িপাল্লার এদিকে বসাই, সময়ের বিদঘুটেপন তুশ্চু হয়ে যায়। আর, "কাঠে টোকা দিয়ে" আমার নতুন বসটা একটু পাগলী হলেও মানুষ ভাল, এই সপ্তাহে খটোমটো কিছু শিডিউল করেনি।

শুরু হল সোমবারের মিটিং টিটিং। 


September 27, 2012

ঝটিকা সফর - ৩


আমি আবার একটু hypochondriac আছি, যেটাকে মা বলে ভ্যানতাড়া আর প্রদীপ্ত বলে Munchausen Syndrome। রোববার সকালে যেন শুনলাম মশার পিনপিন শব্দ, তিড়িং করে ঘুম পালিয়ে গেল। খবর কাগজ চা বিস্কুট টেবিলে গুছিয়ে পা গুটিয়ে বসলাম, কিন্তু পায়ে কুটকুট করছিল।

মা গম্ভীরসে বলল "আমাদের বাড়ির মশায় ডেঙ্গু হয় না, ওরা আমগাছের মশা"। তারপর স্বপক্ষসমর্থনে শম্পা, সুনীতা, সুমিত্রাদি সবাইকে সাক্ষী দেয়ালো "বল? তোদের মশা কামড়েছে কিনা? (মস্তকহেলন) ডেঙ্গু হয়েছে? কিছু হয়েছে? (মস্তকদোলন) ব্যাস কিছু হয় নি পায়ে, আর ধুনোর গন্ধে আমাদের asthma হয়"। তাও সিট্রোনেলা মোমবাতি জালিয়ে টেবিলের তলায় স্থাপন করলাম, পিঙ্গুর নাক বাঁচিয়ে।

খেলার পাতাটা পড়ছি, মামী এসে পড়ল "টুলুদি আমায় একটু চা পাতা দাও, দুধটাও জ্বলে গেছে" (মামী রেগুলার গ্যাসে দুধের কড়া বসিয়ে ব্যাঙ্কে যায়)
মামীকে বললাম "দেখেছ পোনোবদা এসেছে কলকাতায়, সবুজ কার্পেট পেতে দিদি ওয়েলকাম করেছে।"
মামী অবাক হয়ে বলল "সেকি, খরাজ আজকাল এখানে থাকে না?"
তারপর আমার ?? মুখ দেখে বলল " ভূতের ভবিষ্যৎ এর প্রমোদ প্রধানের কথা বলছিস তো? ওটা খরাজ ছিল, পল্টনের বন্ধু খরাজ রে।"
আমি মিহি করে বললাম "পোনোবদা মানে প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায় মামী।"
"ও, দেখেছিস, মাথাটাই গেছে "

এই ফাঁকে বনিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোকে মশা কামড়েছে? অম্লানবদনে উত্তর এলো - হ্যাঁ, রোজ কামড়াচ্ছে, তোর ব্লাডগ্রুপটা জানিয়ে রাখ। শুনেটুনে চারদিকে RAID স্প্রে করলাম। মহা ঝঞ্ঝাট তো!

চিন্তিত ভাবে Mocambo পৌঁছলাম, সেখানে অভিষেক সপ্তদ্বীপা এলিনা দেবজ্যোতি ঋষিরাজ দীপাঞ্জনের সাথে লাঞ্চাড্ডা। একজন ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করা হল মশা তাড়ানো কয়েল আছে কিনা, তারপর ভাগ্যিস পা গুটিয়ে বসেছিলাম, কারণ কাদের কাদের যেন কামড়াল। এদিকে অভিষেক "ঘৃণা লজ্জা ভয় তিন থাকতে নয়" পলিসিতে এদিক ওদিক টেবিলের দিকে আঙুল দেখিয়ে ওয়েটারদের জিজ্ঞেস করছে "আচ্ছা ওরা কি খাচ্ছে? ওটা কি বলুন তো? ওই ওরা যেটা খাচ্ছে, সেটা দু প্লেট দেবেন। দাঁড়ান দাঁড়ান, এটা কি নিয়ে যাচ্ছেন, বেশ দেখতে - এটাও দু প্লেট দেবেন।" 

এর মধ্যে সামনের টেবিলে তিনজন এসে বসলেন, ভদ্রলোকের বয়েস হবে ষাটের কোঠায়, এক মহিলা পঞ্চাশের আশেপাশে, অন্য মেয়েটি হয়তো ত্রিশ। অত্যন্ত অবান্তর গেসিং গেম শুরু হোল - আচ্ছা উনি কি পাত্রী দেখতে এসেছেন? কোনজন পাত্রী? নাকি অনলাইন আলাপ, আজ প্রথম দেখা, গার্ড দেওয়ার জন্যে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন? নাকি বিছড়া হুয়া পুরনো প্রেম? মুখের অভিব্যাক্তি দেখছিস? এটা পুরনো আলাপ হতেই পারে না.. আমরা খুব ইনভল্ভড হয়ে পড়লাম। গলার আওয়াজ কারুরই কম না, পাশের টেবিলের ছেলেটা আমাদের কথোপকথনে উসখুস করছিল, হঠাৎ সপ্তদ্বীপা তার পায়ের কাছে গড় হয়ে "ব্যাগটা পড়ে গেছে দেখি একটু" বলায় বেজায় খচে গেল। 

এত কিছুর পরেও আমরা লোকলজ্জা ত্যাগ করে নানা উপাদেয় খাদ্যাদি সাঁটিয়ে প্রভূত আড্ডা মেরে বাড়িমুখো হলাম। চকোলেট দেবজ্যোতি আর ঋষিরাজ ভাগ করে নিল, ৮০-৪০ ওজন অনুপাতে।

সন্ধ্যেকাল। বেকবাগানে কাকিমার জন্মদিনের নেমন্তন্ন। সেজেগুজে পৌঁছে গেছি, কাবাব খেতে খেতে কাকিমা ঋতশ্রী মামী মা বনি সবাইকে আমার বুটক্যাম্পের গল্প শোনাচ্ছি - এই করতে হয়, ওই করতে হয়, পুশআপ, স্কিপিং, "দেখেছ আমার কি মাসল হয়েছে হাতে?" (বনি পাঞ্জা লড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল...মাথা খারাপ নাকি, তারপর ভাঙা হাত নিয়ে ফিরতে হবে) এই সব কথা হচ্ছে আর সব্বাই অকারণে হাসছি। মামীও খুব হেসে বলল " হ্যাঁ, ঠিক মেরী ডট কমের মত "।

ইফ কম ইজ হিয়ার, ক্যান ডট বি ফার বিহাইন্ড?

দারুণ দারুণ সব রান্না হয়েছিল, খেয়ে দেয়ে বাড়ি এসে ভাইকিংকে ফোনে বিস্তারিত বিবরণ শোনালাম। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল " যা তোরাই তাহলে আনন্দ কর "

আর ও ব্যাটা যে পুজোর কলকাতায় এসে আনন্দ করবে? তার বেলা?

ঝটিকা সফর - ২


পরের দিন সক্কালবেলা পিঙ্গু বিস্কুট নিয়ে এসে ডাকাডাকি করতে লাগলো, ও খাবে আর আমাদের দেখতে হবে। সেই দেখে আমার বিস্কুটখিদে পেল। চা - bourbon cream খেয়ে  শাবানার কাছে যাব - হেনা লাগিয়ে দেবে, মুখে গুঁড়ো গুঁড়ো কীসব লাগিয়ে মেজে দেবে ইত্যাদি - এর মধ্যে কাকিমার বার্তা, আমার জন্যে "এই একটু" গলদা চিংড়ির মালাইকারি আর নকুড়ের মিষ্টি পাঠাচ্ছেন :) তারপর কাল সন্ধেবেলা নেমন্তন্ন, দুপুরে Mocambo তে ক্যুইজ-বন্ধুদের সাথে খাওয়া দাওয়া - খুব প্যাকড প্রোগ্রাম।

মা সখেদে আপত্তি করছে - এই শুরু হোল টো টো করা - বাড়ি এসে একটু রেস্ট করবি তা নয়...(আমি) মা, আমি মায়ামিতে সারাদিন রেস্ট করি, এখানে এসে একটু ঘুরতেও দেবে না? তুমি কি চাও না আমি আনন্দ করি? (মা) যা ইচ্ছে কর আমি আর কিছু বলছি, দুপুরে কি খাবি? (আমি) আবার খাওয়া? ওফফ যা আছে তাই খাব, যা নেই তা কি করে খাব? (বনি) তোমরা প্লিজ বাইরে গিয়ে ঝগড়া করবে? আমি একটু ঘুমোচ্ছি।

এর মধ্যে Emirates ফোন করে প্রভূত ক্ষমা চেয়ে জানাল সুটকেস বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে। ডিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস বলতে বলতে হেনারঞ্জিত মাথা নিয়ে বাড়ি এলাম, দুঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলতে হবে। পিঙ্গু এসে ব্যাপারটা দেখেশুঁকে, এক রাউন্ড হেঁচে নিল। মালাইকারি এসে গেছে - অতি সামান্য, ১৫টি ইয়া সাইজের চিংড়ি। সঙ্গে অনবদ্য মাছের কাবাব আর মিষ্টি। খেয়ে, মাথা ধুয়ে, একটু আনন্দবাজারটা নিয়ে একটু গড়িয়ে নেব প্ল্যান, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। বৃষ্টি পড়ছে, ঘরের মধ্যে ঝিমঝিমে অন্ধকার, দিবানিদ্রার আর দোষ কি!

রাত্তিরে তানিয়া, সৌম্যদাদা সব এসে হাজির। আড্ডা মেরে পিঙ্গুর নাচ দেখে সুটকেস ব্যাগপত্র গুছোতে গেলাম। আমার আবার ভয়ানক geometric insecurity আছে, চারপাশটা ঠিকঠাক রাইটঅ্যাঙ্গেল প্যারালাল সেন্টার না হলে মাথায় কটকট করে। সুটকেসটা সোজা করে রেখে, পাশে সার সার করে হ্যান্ডলাগেজ, ল্যাপটপ ব্যাগ সব রেখেছিলাম। এখন দেখি সব ঘেঁটে গেছে। গজগজ করছি আর টেনে টেনে সমান করছি :
(আমি) মা সুমিত্রাদি কে বলবে জিনিস যেরম ছিল সেরম করে রাখতে সব হিজিবিজি করে দিয়েছে 
(মা) তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে? এই বৃষ্টির মধ্যে সুমিত্রা যে আসছে সেটাই অনেক, চারদিকে জ্বরজারি কত হচ্ছে জানিস? 
(আমি) তা এসে যখন পড়ছে, সোজা করে রাখলেই পারে 
(মা) আমি পারব না বলতে, একটা কাজের লোক পাওয়া যায় না তার মধ্যে সোজা উল্টো 
(আমি) ঠিক আছে, এই ঘর মুছতে হবে না কদিন থাক 
(মা) তারপর মশা দেখলে চিল চিৎকার করিস না যেন 
(আমি) ইয়ে...মশা? 
(মা) হ্যাঁ। কোন জগতে থাকিস? ডেঙ্গু হচ্ছে এখানে পড়িস নি? 
(আমি)ও বাবা, মুছুক তাহলে - ফিনাইল দিয়ে যেন মোছে আর ধুনো আছে নাকি, মা? 
(মা) ধুনো দরকার নেই, বাড়াবাড়ি কোরো না।

মশাতঙ্কে ঘুমোতে গেলাম, ওডোমস মেখে।

ঝটিকা সফর - ১


সাত দিনের জন্যে কলকাতা ঘুরে এলাম। মাথার মধ্যে প্ল্যানটা ঘুরপাক খাচ্ছিল কদিন ধরে, তারপর টিকিট করে প্রদীপ্তকে casually বললাম আমি কলকাতা যাচ্ছি (যেমন মাঝে মধ্যেই অস্টিন যাই, এমন একটা ভাব)। শুনে বিমর্ষ হয়ে ফুচকা খেতে মানা করল, কিন্তু কবে যাচ্ছি কবে ফিরছি সেসব আর জিজ্ঞেস করল না। আমিই ফড়ফড় করে বললাম এই দিন airport পৌঁছতে হবে এই দিন আনতে হবে ইত্যাদি। মা কে সারপ্রাইজ দেব, এই প্ল্যান।

মায়ামি থেকে নিউ ইয়র্ক হয়ে দুবাই পৌঁছে মাকে sms করলাম আমি একটা সেমিনারে খুব ব্যাস্ত আছি, ফোন করতে পারছি না। মা উত্তর দিল "ঠিক মত খেয়ে নিস"।
এই খাওয়া ব্যাপারটা নিয়ে এত ইয়ে... যাকগে, কথা না বাড়িয়ে আমি চকোলেট কিনতে গেলাম।

কলকাতা পৌঁছে দেখি ফোনটা কাজ করছে না। বিরক্তিকর ব্যাপার, তারপর সুটকেসও আসছে না। ইতি উতি ঘুরছি আর ভাবছি কেন এত দেরি - হঠাৎ শুনি আমার নাম ঘোষণা করছে। (নিউ ইয়র্কেও গমগমে স্পিকারে বিকৃত উচ্চারণে আমাকে ডাকাডাকি করা হচ্ছিল, কারণ আরেকটু হলে প্লেন মিস করছিলাম)। তো স্যুটপরিহিত চিমসেপানা এক ছোকরা আমাকে সবিনয়ে জানাল যে আমার সুটকেস আসে নি। আমি যত বাংলা বলি সে তত ইংরিজি বলে। তারপর গুচ্ছের ফর্ম ধরিয়ে ভরতি করতে দেয়, যেন দোষটা আমারি। ঝাড়া আধ ঘণ্টা লাগলো সেই baggage report তৈরি করতে, তারপর তারা বড় সাহেবের কাছে সই করাতে গেল। আমি এর মধ্যে গটগট করে বেরিয়ে বনি /  ভোঁদুকে বলতে গেলাম কেন আমার দেরি হচ্ছে । ফেরার সময় পুলিশদাদা আটকাতে গিয়ে বেজায় ধমক খেল। খিদে পেয়েছে, ঘুম পেয়েছে, সুটকেস আসে নি, এই সময় ধাষ্টামো ?

বাড়ি পৌঁছে বনিদের একটু পেছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। মা গেট বন্ধ করতে যাচ্ছিল, আমাকে দেখে কির'ম যেন স্ট্যাচু হয়ে গেল। তারপর তড়বড় করে "একি? তুই এসেছিস? এরম তো কথা ছিল না? কি ব্যাপার? কি কাণ্ড! কি মজা!!" ইত্যাদি নানা সব বলতে লাগলো। তারপর পিঙ্গুকে অনেক আদর করল, বনির পিঠে হাত বোলাল, আর উত্তেজিত হয়ে এঘর ওঘর করতে লাগলো।

আমি এদিক ওদিক ওপর নিচ দৌড়ে সবাইকে জানিয়ে এলাম আমার আগমন বার্তা। চিরন্তন ফিতে হাতে মামী এসে হাজির, মামা ক্রসওয়ার্ড এর কাগজ শুদ্ধু উঠে এসেছে, পিঙ্গু নেচে কেঁদে একসা করছে, দিদু ঘুম থেকে উঠে পড়েছে -  বাড়িতে প্রচন্ড হট্টগোল শুরু হোল। তার মধ্যে মায়ের স্রোতের মত প্রশ্ন " গিজার চালাবো? কোথায় ঘুমোবি, তিনতলায় নাকি এখানে? চা খাবি? ইস কি কান্ড! কবে বেরিয়েছিস? সেমিনারটা গুল ছিল?? বনি সব জানত কিন্তু আমায় কিছু বলে নি? হিইইইইইই!! "

পিঙ্গু এদিকে দিশেহারা হয়ে একবার বড় খাট একবার ডিভান লাফ দিচ্ছিল, কোঁওওও কুঁউউঁউঁ নানারকম আওয়াজ করে। তারপর একদম velcro হয়ে গদগদ মুখ করে হাত/গলা/মুখ চেটেই চলল, আর ক্ষণে ক্ষণে handshake করল (পিঙ্গু ভয় পেলে, অথবা প্রচন্ড আনন্দিত হলে হাসি/কান্না মুখে handshake করে)। তারপর পেছন পেছন দৌড়তে লাগলো ওপর নিচ, আমার সঙ্গে বাথরুমেও ঢুকে গেছিল। মা যখন তাকে খাওয়াতে বসাল, মাঝে মাঝেই ঘাড় কাত করে দেখে নিচ্ছিল আমরা ঘরে আছি কিনা, একবার ঝোল-মাখা মুখে এসে ঢুঁসিয়ে গেল। সেদিন রাত্রে গরম লাগা সত্ত্বেও বড় খাটে আমাদের মধ্যে শুল, আর ঘুমের মধ্যে কিরম যেন সাঁতার কাটার মত করছিল। 

সুটকেস নেই, চানটান করে বনির পাজামা আর টি শার্ট পরে ফোন করলাম। "দিদি? আমি এসে গেছি, তুই কাল আয় শিগগির (তুই কি সত্যি পাগল পম, ডেলি প্যাসেঞ্জার নাকি?) ঝুম? হাহাহা ইয়েস আমি আবার চলে এসেছি (এটা তুইই পারিস...সোনামাসি কতায়? কতায়?) ভিক্স!! আরে এটা আমি - নতুন নম্বর কারন পুরনো সিমটা ভোঁদাফোন নারায়ণ করে দিয়েছে (তুই যে কেন ফেরত যাস সেটাই আমি বুঝি না...দিদিভাই এসেছ? ভেরি গুড - এটা বুবুন) তারপর প্রদীপ্ত কে একটা মেসেজ করে দিলাম, দিনের বেলা ফোনে কথা বলার সময় দেন না Dr. Rosenberg"...যাকে সবাই "Lion King" বলে ডাকে...

ওদিকে মা জনে জনে ফোন করে খবর দিচ্ছে - "ঠাকুরপো? কেমন আছ? হাঁটু ব্যথা কমেছে? মা ভাল আছেন...এই ত...আজ  কি হোল বল তো? একটু আগে মাম্পু এসে পৌঁছেছে। হ্যাঁ!! আমি তো কিছুই জানি না, তকাই বলল ইলিশ মাছের ঝোল করে রাখ আর কফি কাস্টার্ড, আমি ভেবেছি শনিবার বলে বোধয়...তারপর দেখি সিঁড়ি দিয়ে "হ্যালো মা" বলে উঠছে। আমি যে তখন কি করব কি বলব ভেবেই পাচ্ছি না...  মাথা গুলিয়ে গেছে...হ্যাঁ সাত দিন মাত্র সময়, রাত্তির জেগে অফিস করবে..."
"টুকা? কি করছিস? না এখন খাব কি, সবে এগারটা বাজল। আজ কি হয়েছে বল তো? একটু আগে মাম্পু এসে পৌঁছেছে......(বাকিটা আর লিখলাম না)
" অমুক? কেমন আছ? আজ কি হয়েছে বল তো?" ইত্যাদি

খেতে বসতে বসতে রাত্তির পৌনে একটা বাজল। বনি মেথি চিকেন বানিয়েছিল - দারুণ খেতে হয় সেটা - আর মা করেছিল ইলিশ মাছ। খেতে খেতে কথা হচ্ছে মাছের কত দাম কি বৃত্তান্ত..মা বলল ইলিশ মাছ তো আমার পথ্য, ডাক্তার খেতে বলেছে ওমেগা থ্রি আছে বলে, কিন্তু যা দাম - রোজ কি আর খাওয়া যায়? বনি খুব গম্ভীর হয়ে বলল "তাহলে কাল থেকে ওমেগা থ্রি ক্যাপসুল দিয়ে পাঁচ ফোড়নের ঝোল বানিও"।

এঁটো হাতে আড্ডা মারছি, দেড়টা বাজে - মামা এসে পড়ল। হাতে একটা বাটি। পেছনে চিরুনি হাতে মামী।
আমি - একি মামা এখন খাও নি?
মামা (ব্যাজার মুখে) - না আর কি খাব, বিকেলে মামী এমন এক ধামা মুড়ি বাদাম দিয়েছে, পেট ঢাই হয়ে আছে...
মামী (বিস্মিত) - এক ধামা? এইটুকু বাটিতে মুড়ি দিলাম তো, আর তুমিই চাইলে...
আমি (কাজিয়াটা আটকে) বাটিতে কি?
মামা - এটা হোল চিংড়ি মাছ, খেয়ে নে।
আমি - এখন তো মিষ্টি খেয়ে ফেললাম, কাল খাব নাহয়?
মামা - এটাও মিষ্টি, ওনলি গোলমরিচ আর বাতাবিলেবু দেওয়া।
আমি (হাঁ করে) - বাতাবিলেবু?
মামী - দেখ না আমি বলেছিলাম একটা রেসিপি পেয়েছি, অমনি রান্নাঘরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল - আচ্ছা কাল খাস।
মামা - ঠিক হ্যায়, সামনের সপ্তাহে বিরিয়ানি করব নাহয়, আর স্লাইট ভেটকি ফীলে।

আমরা সমবেত কণ্ঠে আনন্দ প্রকাশ করলাম। নানা আড্ডা হাহা হিহি চলল ভোর রাত্তির অব্দি। শুতে যাওয়ার সময় শুনি কাক ডাকছে। আহ! কদ্দিন পর কাকের ডাক!