২০০৫ সালে যখন তিনটে ঢাউস সুটকেস এবং এক ঝোলাব্যাগ বই নিয়ে বাল্টিমোর এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম, মনে হয়েছিল "আমি একা"। আজ, ২০০৭ সালে, একটা ছোট সুটকেস, একটা ল্যাপটপ ব্যাগ আর অহং-থলি নিয়ে যখন অস্টিন এয়ারপোর্টে নামলাম, মনে হলো "আমি ভয়ংকর একা"।
একটু বুঝিয়ে বলি।
যখন এদেশে এলাম, সেজমাসি এয়ারপোর্টে নিতে এসেছিল, চেনাশোনা মানুষ। তারপর যেখানে যাচ্ছি সেই ইউনিভারসিটির অনেকের সাথে চেনা পরিচিতি হয়ে গেছিল। কাজেই, একা বটে, কিন্তু একটু আধটু চেনা নাম চেনা ইমেইল এড্রেস ছিল। কিন্তু কোথায় থাকব ঠিক নেই, ক্লাসের পড়ায় পাশ করব কিনা ঠিক নেই, কোনো নতুন বন্ধু হবে কিনা তাও জানি না, পড়ার শেষে চাকরি পাব কিনা তারও ঠিক নেই। সম্পূর্ণ আনসার্টেন একটা ব্যাপার। তাতেই মনে হয়েছিল, আমি একা।
অস্টিন এর পরিস্থিতি অন্য। পাশ করেছি, চাকরি পেয়ে মাইকেলকে ধন্য করেছি, কোম্পানির খরচে প্লেনে চড়ে এসেছি।বইপত্র জামাকাপড় কোম্পানির মুভাররা বাড়ি পৌছে দেবে, আমার টিকিট ওরা করে দিয়েছে, দুই সপ্তাহের জন্যে বাড়ি ও ভাড়া করে দিয়েছে। এখন একটা গাড়ি ভাড়া করে, স্বহস্তে চালিয়ে, হোটেল অব্দি পৌছনোর ওয়াস্তা। তাও মনে হলো আমি "ভয়ংকর" একা। কারণ কাউকে চিনি না। কাউক্কে বলতে কাউক্কে না । আমার যিনি বস হবেন, তেনার একটা ফোন্নং আছে, ব্যাস। ভেউ ভেউ। একটা বাংলা বলার লোক ও নেই!
লাল টুকটুকে গাড়ি চালিয়ে গুটগুট করে হোটেল, তারপর সেখান থেকে আসবাবহীন অ্যাপার্টমেন্ট, তারপর হুড়মুড় করে গাদা মালপত্র এসে পড়া, অফিস এর রাস্তা চিনে নেওয়া, সবই হলো। কিন্তু সারাদিন ইংরিজি কথা, বাড়ি ফিরে ইংরিজি টিভি, মাঝে মধ্যেই মনে হতে লাগলো, ইস সিটিব্যাঙ্ক গেলেই ভালো হত - নিউ ইয়র্কে দুটো বাংলা বলে বাঁচতাম।
এমন সময়...
ইন্দিরা পিসঠাকরুনের দৌলতে একটা ইমেইল ডালপালা ছড়িয়ে অনেক ঘুরে "গানের আসর" এর নিমন্ত্রণ নিয়ে এলো আমার কাছে। দুরু দুরু বক্ষে "যাব" উত্তর দিলাম, মৈত্রেয়ী মিত্র কে। উনিই ব্যবস্থা করলেন আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসার ও পৌছে দেবার। গানের আসর, দুটো গান মাথায় রাখলাম, যদি গাইতে হয় ।
রবিবার, ২৯ জুলাই, বিকেলে গানের আসর। পড়ন্ত বেলায় অনেক-দিন-না-পরা শাড়ি বার করে, সেজেগুজে তৈরী। শিবনাথদা এলেন সময় মত, গিয়ে পৌছলাম Steiner Ranch এ। গানের আসরে অনেক লোকজন, মৈত্রেয়ীদি আলাপ করিয়ে দিলেন সবার সাথে। চারদিকে শাড়ি পাঞ্জাবি বাংলা কথা হাসি, টেবিল এর ওপর ঝালমুড়ি চা, সামনে হারমোনিয়াম, তবলা, মাইক্রোফোন, তার মানে সত্যিই গান হবে! জুলাই মাসের ঘোর গরমেও মনে পুলকের দখিনা বাতাস লাগলো, এ যেন লম্বা শীতঘুমের পরে বসন্তের কলকাকলি!
আসর শুরু হলো। সুন্দর গান, কবিতা, আলোচনা। ততক্ষণে আমি একটু একটু কনফিডেন্স পাচ্ছি, এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, টুকটাক কথা বলছি। এলো আমার পালা। ঢেঁকির পাড় চেপে মাইকের সামনে বসে, হারমোনিয়াম এর স্কেল ধরলাম। অচিন্ত্যদা একটু হেসে তবলাটা বাঁধলেন, আর আমার ধড়ে প্রাণ এলো। প্রথমে "আমার প্রানের পরে চলে গেল কে" তারপর "আজি বিজনঘরে" গাইলাম, তারপর আরো সবাই অনবদ্যভাবে অনুষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে চললেন। আসর শেষে খাওয়া দাওয়া, আরো গল্প, পরের আসরের পরিকল্পনা, দুগ্গাপুজোর প্রোগ্রাম, বিজয়া সম্মিলনী, কত নতুন বন্ধু...ব্যাস, অচেনা একটা শহর মুহূর্তে চেনা হয়ে গেল আর মনের পাখি ডানা মুড়ে ঝপ করে বসে পড়ল সেখানে।
আজও আমি মনে প্রাণে অস্টিনাইট, সে যেখানেই থাকি না কেন।