তেরই এপ্রিল। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে উঠলাম সাড়ে সাতটার সময় – উঠে দেখি সে সাজসজ্জা করে বাসী কফি খেয়ে কাজে বেরিয়ে গেছে। এদিকে ফোনটা টেবিল বিরাজমান আর আমার চাবির গোছাটা নেই; তার মানে যে গাড়িতে তেল নেই, সেটাই নিয়ে বেরিয়েছে। আবার ফোন ফেলে গেছে, কি অদ্ভুত আক্কেল! এই সব সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতে দরজা জানলা খুলে দেখি ফটফটে নীল আকাশ, প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছে, বোগেনভিলিয়াতে তিনটে-পাঁচটা ফুল এসেছে। মনটা খুশি হয়ে উঠলো – আজ শুক্কুরবার, কাল পয়লা বৈশাখ!
কফি বসিয়ে চট করে আপিসের ইমেল দেখে আনন্দবাজার পড়তে যাব যাব করছি, এমন সময় আমার ক্লিনিং লেডি এসে উপস্থিত। কি ব্যাপার – আজ তো তার আসার কথা না? এর কথা একটু বলে নি, নাম ফাবিওলা, ধাম কলম্বিয়া। সেখানে উকিল ছিল, তারপর অ্যামেরিকায় এসে ইংরিজি শেখার অনিচ্ছের দরুণ এখন বাড়ি পরিষ্কারের ব্যবসা করে। আমার থেকেও বাতিকগ্রস্ত, আর এতই বাক্যবাগীশ যে ওর ইংরিজি অথবা আমার স্প্যানিশ বলতে না পারায় ওর কিচ্ছু আসে-যায় না ।
তো সে আজ এসেছে কেন? দরজা খুলে আমি হেসেটেসে গুড মর্নিং বললাম,তারপর জিগ্যেস করলাম - "today why come?" ওর সঙ্গে সাধারণতঃ এইভাবে কথোপকথন চালাতে হয়। উত্তরে সে একগঙ্গা কথা বলে গেল, যার মধ্যে থেকে আমি "pero", "como se ise", "columbia" "manana" এই কটা কথা ধরতে পারলাম. কিন্তু গোটা বক্তব্যটা বোঝা গেল না। অগত্যা Google Translate খুললাম কম্পিউটারে (সময়বিশেষে ওর সঙ্গে এভাবেও কথোপকথন চালাতে হয়)।
অনেক পরিশ্রমের ফলস্বরূপ জানা গেল যে ওরা দশদিনের জন্যে "দেশে" যাচ্ছে তাই আজ আমার বাড়ি পরিষ্কার করতে এসেছে।
ভালই হলো - সংক্রান্তির দিনে "বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক", Vacuum-cleaner এর হাঁড়িচাঁছা শব্দে বাড়ি মুখরিত হলো | ফাবিওলা পাপোশ, ছোট কার্পেট ইত্যাদি সোফার ওপর তুলে রেখে, যত্রতত্র জুতোপায়ে ঘুরে ঘুরে পরিষ্কার করতে লাগলো। আমি শিউরে উঠে কাজে মন দিলাম - যস্মিন্ দেশে যদাচার।
ঘন্টাদুয়েক পরের কথা। কাজে মনটা বেশ ডুবে এসেছে, আরেক কাপ কফি আর গোটা পাঁচেক krackjack বিস্কুট শেষ করে এনেছি, এমন সময় +৯১ নম্বর থেকে ফোন। চমকে উঠে ঘড়ি দেখলাম - কলকাতায়ে মাত্র রাত্তির ন'টা, এই অসময়ে ফোন কেন? "হ্যালো, মা? কি ব্যাপার? রেখে দাও, আমি করছি – না, মিটিং নেই , থাকলে ফোন ধরলাম কি করে? দেড় কিলো মাছ রান্না হচ্ছে? বাঃ দারুণ ব্যাপার মা – না, এখানে কাতলা মাছ পাওয়া যায় না, আর কাঁচা আম এখনো দেখি নি.. নতুন জামা? আছে। আমি তোমায় পরে ফোন করছি মা।" সংক্রান্তি উপলক্ষে বাড়িতে আম-মাছ রান্না হচ্ছে; ঝোলটা বেজায় ভালো হয়, এদিকে কাতলা মাছ আমার দু-চোখের বিষ, দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়। বেশ একটা হরিষে বিষাদ ব্যাপার।
ফাবিওলা ইতিমধ্যে কাজকর্ম শেষ করে এনেছে, যন্ত্রপাতি গুটিয়ে টাকা নিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে জানালো যে ও আমার জন্যে কলম্বিয়ান কফি নিয়ে আসবে, আরো কি একটা আনবে সেটা বুঝতে পারলাম না – হাত দিয়ে চৌকো মত দেখাল – পোস্টকার্ড কিংবা চকোলেট বোধহয়। ওকে দুগ্গা দুগ্গা বলে এগিয়ে দিলাম, পয়লা বৈশাখে যাত্রা, ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুক বাবা। ও আমার পরিষ্কারের definition খুব ভালো বোঝে।
দুপুর আসন্ন। কুইজ গ্রুপে খানিক আড্ডা মেরে কি খাওয়া যায় ভাবছি, পিড়িং পিড়িং করে Skype থেকে ডাকাডাকি| মামীর মুখ ভেসে উঠলো অচিরেই, পাশে মামীর মেয়ে। স্রোতের মত কথা ভেসে এলো " পম্পি? কানে ওটা কি লাগিয়েছিস? এমা, তোর মুখটা এমনি কালো কালো লাগছে কেন? চশমা পরেছিস লাল রঙের? আমেরিকাতে লোকে ফর্সা হয় আর মোটা হয়, আচ্ছা তোর এখন বিকেল না রাত?" ইত্যাদি ।
"মামী? এটা হেডফোন। আর আমার মুখে কিছু হয় নি, আলোর উল্টো দিকে আছি তাই, আর ফোন থেকে মুখটা distorted লাগছে। চশমা মোটেই লাল নয়। তুমি মাথায় ফিতে বেঁধেছ কেন?"
"এই তো ফিতেটা ফেলে গেছিলাম গতবার, এখন চুল বাঁধছি।আমরা ঝুমকির কাছে এসেছি, জানিস তো? আচ্ছা তোরা নববর্ষে কি করবি?”
"জানি মামী, ঝুমকিই তো ফোনটা করলো, তুমি ওর কাছে না থাকলে কি করে তোমায় ওর ফোনে দেখছি? নববর্ষ বলে এখানে আলাদা কিছু বুঝছি না। আচ্ছা, Pixi কোথায়?"
বোনপোর আবির্ভাব, কপালে একটা লাল টিপ, মাথায় নানা রঙিন পালক লাগানো একটা মুকুট-জাতীয় কিছু। সে খানিকক্ষণ আমাকে বাঘের পিঠে খাওয়ার গল্প পড়ে শোনালো। তারপর ভিডিও দিয়ে আমার ফ্রিজের ভেতরটা দেখে নানা মন্তব্য করলো "কত্ত কত্ত আপেল! প্রেসার কুকের কই? কুকাম্বার নেই? ভেজিটেবিল?" (আমার ফ্রিজে সত্যি ভেজিটেবল নেই - রান্নার পাট outsource করা আছে এক পাঞ্জাবী মহিলার কাছে) তারপর ঠাকুরের তাক দেখে "সর্বমঙ্গলা মঙ্গল্যে" আওড়ে, মুখ দিয়ে বিচিত্র "পুঁপুঁ" শব্দে শাঁখ বাজিয়ে, দুম করে ফোনটা কেটে দিল। অনেক চেষ্টা করেও আর লাইন পেলাম না। অগত্যা ক্ষুন্নিবৃত্তি করে আবার আপিস।
এরপর গতানুগতিক বিকেল সন্ধ্যে রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়ার পর রাতে মাকে মেসেজ করলাম। মা খুব ব্যাস্ত, পিঙ্গু (আমাদের গোল্ডেন রিট্রিভার) নিমপাতাসেদ্ধ জলে চান করছে, চায়ের সসপ্যানে নিমপাতা সেদ্ধ করা হয়েছে তাই চা তেতো, ঠাম্মা সেটা খেতে পারছে না, এদিকে বড়মাসি দক্ষিণেশ্বর গেছে তিনঘণ্টা হয়ে গেছে – এইসব নানা ঘটনা। নতুন বছরের প্রণাম জানিয়ে ফোন রাখলাম।
ঘুমোতে যাবার আগে টুক করে ফেসবুকে একটা উঁকি দিয়ে দেখি, ওমা! সন্তুদাদা বিয়ে করে ফেলেছে – আর ওদের ওখানে তো আজই পয়লা বৈশাখ! কানাডাবাসিনী সুসানকে “ডেট” করছিল শুনেছিলাম, কিন্তু দুম করে বিয়ে? বড়মাসি কলকাতায়, ওদিকে বিয়েটা অস্ট্রেলিয়ায় হয়েছে, পাত্রপাত্রী সবার বেশ হাশিখুশি ছবি উঠেছে – নিশ্চয়ই লুকিয়ে বিয়ে করছে না? যাক, নিশ্চিন্দি, নতুন বছরে নতুন জীবন শুরু। প্রদীপ্তকে খবরটা জানালাম। ও সন্তুদাদা, সুসান, কাউকেই চিনতে পারল না, কিন্তু বলল ভেরি গুড, খুব ভাল খবর, ওদের কনগ্রাচুলেশান্স জানিয়ে দে। চিঙ্কি সাধে আমাকে “mad-net” বলে?
পরের দিন। সকাল থেকে আকাশ কালো করে ঝড়বৃষ্টি আর আমার মন খারাপ – ইসস, কলকাতায় কালবৈশাখী হলে ছোটাছুটি করে আম কুড়োতাম, উড়ন্ত শিমূলতুলো ধরতাম। আর শিলাবৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এখানে ছাই না শোনা যায় মেঘের গর্জন, না পাওয়া যায় বৃষ্টির গন্ধ, না দেখা যায় হাওয়ায় ওড়া খবরের কাগজ – এইসব গজগজ করছি আর রুপুদির বর্ষার গানের সিডিটা খুঁজছি, এমন সময় “ পিঙ্গি! কি করছিস, কেমন আছিস? আমরা বম্বে চলে যাচ্ছি, জিনিস সব প্যাক হয়ে গেছে, এখন হোটেলে আছি আর কারেন্ট নেই। আমি কাজ করে করে রোগা হয়ে গেলাম।” আটহাজার মাইল নস্যি করে দূরভাষে ভাইয়ের গলা, সঙ্গে বুবুন । খানিক আড্ডা মেরে দেখি বোনের মেসেজ “পয়লা বৈশাখে তোকে একটা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম, প্রদীপ্তদাকে হাফ।” ফোন করলাম, কিন্তু হিজিবিজি কথার ফাঁকে আদ্ধেক প্রণামটা কি ব্যাপার জেনে নেওয়া হলনা।
ওদিকে মা নেমন্তন্ন খেতে গেছে স-পিঙ্গু, ফিরতে দেরি হবে, এদিকে বৃষ্টি ধরে এল – আমাদের বেরোনোর কথা, খানিকদূরের একটা ছোট্ট শহরে যাব। ব্যাগপত্র গুছিয়ে হাইওয়েতে উঠে ফোন করলাম – কলকাতায় রাত্তির সাড়ে এগারোটা, মায়ের সবে সন্ধ্যে।
“আজ যা কাণ্ড হল না? বড়মাসি তো সেই সাতসকালে দক্ষিণেশ্বর গেছে সন্তুর বিয়ের পুজো দিতে একটা লাল সালওয়ার কামিজ পরে।” (আমি জানতাম না বিয়ে)
“সেকি, তোকে বলিনি ওরা পয়লা বৈশাখে বিয়ে করবে ঠিক করল? আমি একদম ভুলে গেছি – ছিঃ ছিঃ, তোকে জানানো উচিত ছিল।“ (ঠিক আছে মা, অত কিছু ছিছি করতে হবে না)
“না না তুই জানতে পারলিনা, এদিকে আমরা সবাই জানি।“ (তাতে কিচ্ছু এসে যায় না)
“তাহলে কাকে বললাম বল্তো?” (মা! তুমি থামবে? সারাদিন কি করলে বলো!)
“হ্যাঁ, সে পুজো দিতে গিয়ে সাড়ে তিনঘণ্টা ধরে গঙ্গায় চান করেছে, তারপর এমন টায়ার্ড হয়ে গেছে যে মন্দিরের অফিসে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে অফিসের লোকদের বলেছে, আমি বুড়োমানুষ, আমার হয়ে একটু পূজো দিয়ে আসবে ভাই? আমি স্নান করে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।“ (এটা অবিশ্বাস্য, মা, বড়মাসি ... নাঃ কিছু বলার নেই)
“তারপর এক চ্যাঙ্গারি প্রসাদ নিয়ে বাড়ি এলো বেলা দেড়টা। আমরা দুটো করে মাছ খেলাম। বিকেলে পিঙ্গুকে নতুন বাটি বার করে দিলাম, আমি নতুন শাড়ি পরে বেরোলাম। তোরা কি করছিস? আমি এখন বই পড়ব।“ (কটা বাজে মা? এত রাত্তির করছ কেন?)
“কোথায় রাত্তির? সবে তো পৌনে বারোটা বাজল!” (না, এখন রাত্তির কেন হবে, ঘোর দুপুর, যাও ঘুড়ি ওড়াও তাহলে)
“বোকা-বোকা কথা বলিস না, খামোখা ঘুড়ি ওড়াব কেন? এই তো একটু বইটা পড়ে নি, দেখি মামী যদি ফোন করে!” (মামী এখন ফোন করবে? তোমাদের প্রব্লেমটা কি বল তো?)
“প্যাঁকপ্যাঁক করিস না তো – আমাকে আমার মত থাকতে দাও, ব্যাস্!” (হোপলেস, মা। ঠিক আছে, টাটা গুড নাইট।)
“নতুন বছরের অনেক আশীর্বাদ নিস তোরা। শুভ নববর্ষ।”
পয়লা বৈশাখ অবশেষে অস্ট্রেলিয়া হয়ে কলকাতা ছুঁয়ে মায়ামিতে নতুন বছর শুরু করল। ১৪১৯ সালে সবার শুভ হোক্।
শুভ নববর্ষ!
(April, 2012)
১) ফাবিওলা ফিরে এসেছিল? চৌকো মত জিনিসটা কী ছিল?
ReplyDelete২) আদ্ধেক প্রণাম কী জানা গেল? এক পায়ে প্রণাম?
১) ফাবিওলা ফিরে এসেছিল। চৌকো মত জিনিসটা ছিল কফির প্যাকেট। নাম বেমোকা।
ReplyDelete২) ওটা বোধহয় হাঁটুতে প্রণাম।